বিশ্ব ঐতিহ্যের সূর্য মন্দির , Sun Temple of Konarak is one of the World Heritage Site of India

               

SUN TEMPLE, KONARAK, ODISSA
Sun temple, Konarak

  ব্ল্যাক প্যাগোডা, সেই সময় ইউরোপিয়ান নাবিকদের কাছে এই নামেই পরিচিত ছিলো আজকের কোণারকের সূর্য মন্দির প্রায় ৭৫০ বছর আগেকার কথা, সূর্য মন্দিরের একদম কাছেই ছিল সমুদ্র কাছাকাছি বয়ে যেত চন্দ্রভাগা নদীও তারপর কেটে গেছে কয়েকশো বছর এই সময়ের ব্যবধানে সমুদ্র সরে গিয়েছে অনেক দূরে; চন্দ্রভাগা নদীরও আর কোনো অস্তিত্ব নাই। এর মধ্যে মন্দির নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বালিতে চাপা পড়ে মানুষের চোখের আড়াল হয়েছে। আবার তাকে উদ্ধার করে আমাদের সামনে হাজির করা হয়েছে। কিন্তু যতই ভগ্নপ্রায় হোক না কেন, মানুষের কাছে আজও বিষ্ময় ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে। অনুপম সৌন্দর্যের অধিকারী এই সূর্যমন্দির ১৯৮৪ সাল থেকেই ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত। এখনো যতবার একে দেখা হয়, ততই যেন বিষ্ময় বেড়ে যায়।

              ছাত্র অবস্থায় ১৯৮০ সালে প্রথমবার কোণারক দর্শন। তারপর সময়ের সাথে সাথে আরো পাঁচবার। কিন্তু প্রত্যেকবারই ভ্রমণসূচীতে পুরী প্রাধান্য পেয়ে এসেছে; আর লেজুর হিসাবে অন্য অনেক জায়গার সাথে কোণারককে একবার বুড়ি ছোঁয়া করা। তাই এইবার পরিকল্পনা ছিল সময় নিয়ে কোণারক দেখব ও তার পাশাপাশি পুরী ঘুরব।      

               যেমন ভাবা তেমন কাজ। পুরী থেকে সকাল সাড়ে সাতটায় গাড়ী করে চললাম কোণারক। গাড়ীর সাথে আমার চুক্তি যতক্ষন খুশী সময় নিয়ে মন্দির দেখবমেরিনড্রাইভ ধরে পুরী থেকে কোণারক প্রায় ৩৬ কিমি। পুরী থেকে বাইরে আসতেই চোখজুড়ানো দৃশ্য। দুপাশে সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে কালো সাপের মতো রাস্তা। কিছু সময় ডানপাশে পেলাম সমুদ্রকে। তবে অনেক উঁচু হয়ে বালি জড়ো হয়ে মাঝে মাঝেই সাগর দেখার মজাটাতে বাঁধার সৃষ্টি করছেদেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম চন্দ্রভাগানদী ও সাগর এখানে এসে মিশেছে। একটু সময় দিলাম এখানে। এখান থেকে আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই কোণারক। ঢেউ ও ডিঙ্গি নৌকার লড়াই ক্যামেরা বন্দী করতে করতে মনে পড়ে গেল বইয়ে পড়া এক পৌরাণিক কাহিনীর কথা, তবে সত্য মিথ্যা বুঝি না।

SUN TEMPLE,KONARAK


                    প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেকার কথা। নারদের ছলচাতুরীতে শ্রীকৃষ্ণ পুত্র শাম্ব তার পিতার অভিশাপে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন। পরে নারদেরই উপদেশ অনুযায়ী শাম্ব এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সূর্যদেবের কৃপা প্রার্থনা করেন ভারতের পূর্ব উপকূলে সমূদ্রতীরে অবস্থিত মৈত্রেয় বনে দীর্ঘ ১২ বছর কঠোর তপস্যা করেন শাম্ব শাম্বের তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে সূর্যদেব তাকে রোগমুক্তির  বর দেন সাগর ও চন্দ্রভাগার সঙ্গমে স্নান করে চিরতরে রোগমুক্তি হয় তার এরপর নিরোগ শাম্ব স্নান করতে নেমে চন্দ্রভাগা সঙ্গমে সূর্যদেবের একটি বিগ্রহ পান তখন থেকেই সূর্যদেবের মূর্তিপুজোর প্রচলন হয় মর্তলোকে এই মৈত্রেয়ী বনই হল অর্ক বা সূর্যক্ষেত্র যা আজকে কোণারক নামে পরিচিত  

                         এসব কাহিনীর কথা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম কোণারকের সূর্যমন্দিরের প্রদেশদ্বারেএখানে বাঁদিকে টিকিট কাটার কাউন্টার আছে সেখানে টিকিট কেটে তবেই ভিতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে প্রবেশপথে প্রথমেই প্রবেশ না করে আমরা বাঁদিকে উঠে এলাম বাইরের উঁচু জায়গা থেকে পুরো মন্দির প্রাঙ্গণকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা ছবি চোখের সামনে হাজির হয়। যতদূর জানা যায় ১২৪৪ খ্রীষ্টাব্দে মন্দির নির্মানের পরিকল্পনা হয় ও ১২৪৬ খ্রীষ্টাব্দে নির্মান কাজ শুরু হয়। ১২০০০ শ্রমিকের ১২ বছর সময় লাগে অসাধারণ এই মন্দিরটিকে সম্পূর্ন রূপ দিতে। গঙ্গা রাজবংশের রাজা নরসিঙ্ঘদেব (প্রথম) এই মন্দির নির্মান করান। প্রধান স্থপতি ছিলেন বিশু মহারানা। এরপর প্রায় ৩০০ বছর নিয়মিত পুজো হয়। ১৬২৬ সাল থেকে মন্দিরের ক্ষয়ক্ষতি শুরু হয়। ১৮৬০ সালে মন্দির ভেঙ্গে পড়ে ও সমুদ্রের বালিতে ঢাকা পড়ে যায় অনেকটাই। ১৯০১ সালে মন্দিরের উদ্ধার ও সংরক্ষনের কাজ শুরু হয় লর্ড কার্জনের অনুগ্রহে। ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় মন্দিরের নানা অংশ। যাতে ভেঙ্গে না পড়ে তার জন্য আমূল সংস্কার করা হয়। ১৯১০ সালে কোণারক মন্দিরের উদ্ধারকাজ সম্পূর্ন হয়। 

                               আজও এর সৌন্দর্য ও কাঠামো দেখে অবাক না হয়ে থাকা যায় না। দূর থেকে দেখলে তবেই পুরো গঠনটা সম্বন্ধে ধারনা করা যায়। তাই কাছ থেকে দেখার  আগেই একবার দূর থেকে দেখে নেওয়া। পূর্ণমন্দিরের রূপটি ছিলো একটি ঘোড়ায় টানা সুবিশাল রথের আদলে। রথ টানছে সাতটি টগবগে ঘোড়া। রথরূপী মন্দিরের চারপাশে রয়েছে ১২ জোড়া চাকা। সবই পাথরের ও অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত। সূর্যদেব বসে আছেন রথে, জানলাম উদিত

সূর্যের প্রথম আলো পড়ত মন্দিরের ভিতরে সূর্যদেবের মুকুটের মধ্যে হীরের উপর। সূর্যদেবের মূর্তিটি মূল মন্দিরের মধ্যে হাওয়ায় ভাসত তাকে এইভাবে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো  চারদিকে শক্তিশালী চুম্বকের আকর্ষন এর মধ্যে একটি ৫২ টনের অতি শক্তিশালী চুম্বক ছিল মন্দিরের মাথায় তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল রথরূপী এই সুবিশাল মন্দিরটি প্রথমে সবচেয়ে উঁচু মূলমন্দির বা দেউল       ( ভিমানা ) তার ঠিক সামনে জগমোহন বা সামনের হল এবং শেষে নৃত্যমণ্ডপ এর মধ্যে  মূলমন্দির এখন ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়েছে আমরা এখন যে উচু স্থাপত্যটি দেখি সেটি আসলে জগমোহন জগমোহনে উঠবার জন্য সিঁড়ি আছে এর সামনে সাতটি ঘোড়া শোভা পাচ্ছে যারা রথটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমি প্রথমবার ১৯৮০ সালে যখন মন্দির দর্শন করি তখনও জগমোহনের দরজা অবধি যাওয়াতে কোন বিধি নিষেধ ছিলো না মন্দিরের অবস্থাও অনেকটা ভাল ছিল ১৯৮৭ সালেও সূর্যদেবের চরণতলে পৌঁছাতে পেরেছিলাম সূর্যদেবের তিনটি ভিন্নধর্মী আলাদা আলাদা মূর্তি শোভা পেত মন্দিরের তিন দিকে এই মূর্তিগুলি ক্লোরাইট পাথরের তৈরী তিনটি মূর্তি এমনভাবে রাখা থাকত  যে সকাল, দুপুর ও বিকাল এই তিন সময়ের সূর্যরশ্মি সূর্যদেবের তিন মূর্তির মুখে এসে পড়ত প্রভাতের সূর্যদেবকে মনে করা হয় সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, দুপুরের সূর্যদেব প্রলয়কর্তা মহেশ্বর ও অস্তাচলগামী সূর্যদেব যেন রক্ষাকর্তারূপী বিষ্ণু এই তিনটি মূর্তিকে ভালো করে লক্ষ করলে এই তিনটি সূর্যদেবের মূর্তিতে সকালের সতেজতা, দুপুরের পূর্ণ উদ্যম ও দিনান্তের ক্লান্তরূপ ধরা পড়ে    

                      যে সমস্ত অনুপম স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের জন্য এই সূর্যমন্দির বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে কিছু শিল্পকলা , স্থাপত্যের কথা না লিখলেই নয় জগমোহনের সামনে যে নৃত্যমণ্ডপ রয়েছে তা উঁচু ভিত্তির উপর তৈরী বেশ কয়েকটা সিঁড়ি অতিক্রম করে তবেই নৃত্যমন্ডপে পৌঁছানো যায় নৃত্যমন্ডপের দেওয়াল ভীষণ আকর্ষনীয় এর দেওয়ালে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নৃত্যরত অসংখ্য মূর্তি শোভা পাচ্ছে নৃত্যমণ্ডপের পূর্বদিকের প্রবেশপথে রয়েছে দুইদিকে দুই গজসিংহ প্রথমে মানুষ, তার উপরে হাতি ও সবচেয়ে উপরে সিংহ মনে করা হয় সিংহ অহংবোধের প্রতীক, হাতি ধনসম্পত্তির প্রতীক এবং এই দুটিই মানুষকে হত্যা করেছে আবার মূল মন্দিরের নীচের দিকে ১৪৫২ টি ভিন্ন মূহুর্তের হাতির মূর্তি সারিবদ্ধভাবে শোভা পাচ্ছে  

                      এরপর আসছি দুটি অসাধারন যুদ্ধ ঘোড়ার মূর্তিতে ঘোড়াটি যোদ্ধাকে পরাজিত করে পদানত করে রেখেছে এই দুটি বর্তমানে দক্ষিনদিকে একটি উঁচু বেদীর মতো জায়গায় শোভা পাচ্ছে এই স্থাপত্যের মাধ্যমে অতিশয় ক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে এই স্থাপত্যের রূপরেখায় বর্তমানে উড়িষ্যা সরকারের শীলমোহর তৈরী হয়েছে

                        আবার মন্দির প্রাঙ্গণের উত্তরদিকে একটি উঁচু বেদীর মতো জায়গায় দুটি মনোরম হাতীর মূর্তি মুগ্ধ করে সকল মানুষকে রথের মতো মন্দিরটিকে টেনে নিয়ে চলেছে সাতটি টগবগে ঘোড়া চারটি ডানদিকে ও তিনটি বামদিকে একটি ঘোড়া এখনো খানিকটা অক্ষত থাকলেও বাকীগুলির ভগ্নদশা মনে করা হয় রামধনুর সাতটি রঙের প্রতীক এই সাতটি ঘোড়া

                      

রথরূপী মন্দিরের ১২ জোড়া চাকার খ্যাতি সমগ্র বিশ্বজুড়ে ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি ব্যাসের এই চাকা কারুকার্যমন্ডিত। এই চাকাতে ৮ টি চওড়া পাখি ( স্পোক ) ও ৮ টি সরু পাখি শোভা পাচ্ছে। চওড়া পাখিগুলির প্রতিটার মাঝে পদকের মতো গোল করে এক জায়গায় নানা কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এগুলি মূলত নানা ভঙ্গিমার নারীমূর্তি। আকার , মাপ ও অলংকার সজ্জাতে প্রতিটা রথের চাকা একই দেখতে। বর্তমানে সম্ভবত একটি চাকাই অক্ষত আছে। কোণারক বেড়াতে এসেছেন অথচ রথের চাকার সামনে ছবি তোলেন নি , এমন মানুষ বোধহয় নেই। এই চাকার পাখিগুলি এমন বিজ্ঞান ভিত্তিক যে এই পাখিগুলির মাধ্যমে সূর্যের ছায়াকে কাজে লাগিয়ে ঘড়ির মতো সময় মাপা যায়। অনেকের মতে সাতটি ঘোড়া সপ্তাহের সাতটি দিনের এবং ২৪ টি চাকা একটি দিনের ২৪ ঘণ্টার প্রতীক।

                        প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে আমরা ধীরে ধীরে সমগ্র মন্দির পরিদর্শন করলাম প্রথমেই মুখোমুখি হলাম গজসিংহের যার কথা আগেই লিখেছি মন্দির আগে দেখা থাকলেও এখানকার অলংকরন থেকে চোখ ফেরানো মুস্কিল তবে মন খারাপ হয়ে যায় যখন ১৯৮০ সালে আমার প্রথম দেখা সূর্যমন্দিরের চিত্রটা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে আমি নানা সময়ের মন্দিরের ছবি দিয়ে এর আসল রূপ মাধুর্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি এছাড়া পিছনের দিকে মায়াদেবী ও ছায়াদেবীর মন্দির দক্ষিন দিকে ভোগমন্দিরের ভগ্নাবশেষ তবে সেই সময়কার কুয়ো আজও আছে দেখতে দেখতে মন যেন আর ভরে না মনে হয় যদি টাইম মেশিন করে সেই আমলে চলে যাওয়া যায় ! অসংখ্য ছবি তুলে খিদে মেটাবার বৃথা চেষ্টা করলাম বুঝলাম বিশ্ব ঐতিহ্যের এই অসাধারণ স্থাপত্য ভাস্কর্যের মোহ কাটিয়ে এই জায়গা থেকে চলে যাওয়া বেশ কঠিন কাজ তাই আজ জোর করে বিদায় নিলেও আবার আসতেই হবে এই বাসনা মনের মধ্যে রয়ে গেল বিদায় কোণারক,  সেলাম সূর্যমন্দির   

তথ্য সূত্রঃ  http://www.shreekhetra.com/konark.html


মন্তব্যসমূহ

  1. দারুণ ব্যাপার দাদা ।তোমার ভ্রমণের ব্লগ এর জন্য অনেক অভিনন্দন । এটার সাফল্য সময়ের অপেক্ষা । আমরা সমৃদ্ধ হবো এটা নিশ্চিত । তোমার ভ্রমণ কাহিনী পড়া মানে মানস ভ্রমণ করা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন