মাতা বৈষ্ণোদেবীর ডাকে , Vaishno Devi Temple of Katra is a famous Hindu temple

        

KATRA RAIL STATION, KATRA , MATA VAISNO DEVI,JAMMU
KATRA RAIL STATION 
  

                                                                                                                             দীর্ঘ দুমাস প্রতীক্ষার অবসানে ‘জয় মাতা দী’ নাম নিয়ে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে নিউ দিল্লীর দিকে রওনা হলাম। ঘণ্টা দুয়েকের আকাশ পথ। মনের একান্ত ইচ্ছা বৈষ্ণোদেবীকে দর্শন করা। এর পরেও হাতে সময় থাকলে তবেই একটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি। দুপুরে দিল্লী বিমানবন্দরে নেমে গেলেও ট্রেন বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। নিউদিল্লী থেকে সরাসরি কাটরা যাওয়ার নতুন সুপারফাস্ট ট্রেনে চেপে বসার লোভ সামলাতে পারিনি। সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এই ট্রেন পরের দিন সকাল পাঁচটা নাগাদ কাটরা রেল স্টেশনে পৌঁছে দিল। কাটরা শহরের নিয়ম মেনে এই ট্রেনেও কোন আমিষ খাবারের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মনোরম পাহাড়ী পথ ও পাহাড় ফুঁড়ে বানানো সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেন এলেও আমরা ভোর রাত্রি ছাড়া বাকী সময় সেই মজা নিতে পারিনি। ট্রেন থেকে নামতেই বুঝলাম অসাধারাণ সুন্দর রেলস্টেশন এই কাটরা। পাহাড়ের কোলে আলো ঝলমলে , ঝাঁ চকচকে এই স্টেশন। এখানে দাঁড়িয়ে ভোরের সদ্য ফোটা আলোয় ত্রিকুট পাহাড়কে কালচে রঙের মনে হচ্ছে। সেই কালচে পাহাড়ের গায়ে মাতা বৈষ্ণোদেবীর মন্দির যাওয়ার পাহাড়ী পথকে জোনাকির আলোয় আলোকিত এক মায়াবী স্বর্গীয় পথ বলে মনে হচ্ছে। স্টেশন থেকে অনেকটা উপরে এসে তবেই গাড়ী, অটো পাওয়া যায়। আমরা একটা গাড়ী করে লজে এলাম। রাতের ক্লান্তি দূর করতে প্রথমেই ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা। এখানে ব্রেকফাস্টে আলুর পরোটা ও আঁচার ছাড়া আর কিছুই মনে ধরলো না। কাটরা জায়গাটার একটু এদিক ওদিক দেখা দরকার এই ভেবে খাওয়া শেষ করে বাইরে এলাম। কাটরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা ট্যুরিষ্ট রিশেপসন সেন্টার আছে। মাতা বৈষ্ণোদেবীকে দর্শন করার জন্য যে পর্চি ( পরিচয় পত্র ) কাটাতে হয় প্রত্যেক দর্শনার্থীকে, সেটা এখানে করার সুবন্দোবস্ত আছে। পর্চি কাটার জন্য নিজের ফটো তোলা বাধ্যতামূলক , এখানে ওয়েবক্যামে তারও ব্যবস্থা আছে। পর্চির মেয়াদ মাত্র ছয় ঘণ্টা, তার মধ্যেই যাত্রা শুরু করতে হবে। আবার অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে মূল প্রবেশদ্বারে পর্চি সংগ্রহ করতে পারেন।  প্রত্যেক সদস্যের কোন একটা পরিচয় পত্র বাড়ী থেকে নিয়ে এলে এখানে কাজের খুব সুবিধা হয়। কাটরা রেল স্টেশনে পর্চি কাটার ব্যবস্থা থাকায় অনেকে সেখান থেকেই দর্শনের জন্য অগ্রসর হচ্ছেন।

WAY TO BHABAN IS SEEN IN TRIKOOT HILL, KATRA
WAY FROM KATRA TO BHABAN 

               

          পাহাড়ী পথে প্রায় ১৪ কিমি অতিক্রম করে তবেই ত্রিকূট পাহাড়ের উপরে প্রায় ৫২০০ ফুট উচ্চতায় মায়ের পবিত্র গুহায় পৌঁছানো যাবে। এখানে দর্শন করার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় নাই। রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই দলে দলে ভক্তরা দর্শনের জন্য  চলেছেন এবং নেমে আসছেন দর্শন শেষে। বেশীর ভাগ পূণ্যার্থী হেঁটে ওঠানামা করলেও যারা অতটা দূরত্ব হাঁটতে পারবেন না, তাদের জন্য ঘোড়া, ডুলি, পিট্টু, হেলিকপ্টার ইত্যাদি নানান ব্যবস্থা আছে পাহাড়ে ওঠানামা করার জন্য। এখানে ভক্তদের বিশ্বাস, মা নিজে কাউকে না ডাকলে তার পক্ষে দর্শন করা অসম্ভব, কোনো না কোনো ভাবে দর্শন অধরা থেকে যাবে।


MAIN GATE WHERE JOURNEY STARTS FOR VAISNO DEVI , KATRA, JAMMU
MAIN  GATE  WHERE JOURNEY STARTS
                            


          এভাবেই হাঁটতে থাকা............    

                                                        আমরা বিকেল ৬-৩০ নাগাদ পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলাম। পথে আমাদের সঙ্গী হলো দোকান থেকে কেনা লাঠি ও কপালে বাধাঁ লাল ফিতে, যাতে লেখা ‘জয় মাতা দী’। নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে আমাদের প্রথম চেকিং হলো প্রধান প্রদেশদ্বারেই, যার নাম ‘দর্শনী দরোয়াজা’। কথিত এই স্থানেই মাতা বৈষ্ণোদেবী ছোট্ট বালিকার বেশে পন্ডিত শ্রীধরকে দেখা দেন। চেকিং সেরে আমরা এগিয়ে চললাম পাহাড়ী পথ ধরে। এগোনোর সাথে সাথে ধীরে ধীরে কমতে লাগল খাবারের দোকান, ওষুধের দোকান, ঘোড়ার স্ট্যান্ড, প্রসাদের দোকান, চায়ের দোকান। শেষে সঙ্গী শুধুই পাহাড়ী পথ। তবে পুরো পথই বাঁধানো অনেক জায়গাতেই মাথায় ছাউনি দেওয়া, পথ আলোয় আলোকিত। দুর্ঘটনা এড়াতে খাদের ধার বরাবর লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। একটু ক্লান্ত লাগলেই পথের ধারে রাখা সুন্দর বসার চেয়ারে বসে একটু বিশ্রাম নিতে ভালোই লাগছে। দেখলাম পথে পানীয় জলের ও শৌচাগারের সুব্যবস্থা মায়ের দর্শনকে আরো সহজ করে দিয়েছে। এগিয়ে চলতে চলতে দেখি কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা লোহার রেলিং দিয়ে দুভাগ করা। একটি রাস্তা দিয়ে আমরা উঠছি, অন্য পথে ঘোড়ার দল যাতায়াত করছে। আবার কোথাও দেখলাম পাকদন্ডী পথের পাশাপাশি চড়াই সিঁড়িও আছে। সে পথে যেতে পারলে অনেক কম সময়ে উপরে ওঠা যাবে কিন্তু কষ্ট বেশী। এই পথ অনেকটা লুডো খেলার মই-এর মতো।

             

       কিছুদূর ওঠার পর নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি ফেলে আসা কাটরা শহরকে ছবির মতো দেখাচ্ছে। পাহাড়ী পথে অসংখ্য মানুষ আমাদের সঙ্গী। আমাদের সামনে একদল ভক্ত ঢোল বাজিয়ে নাচতে নাচতে সারা পথ চলেছেন। মাঝে মাঝে পাহাড় কাঁপিয়ে আওয়াজ তুলছেন ‘জয় মাতা দী’। কিছুদূর পর পর নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে পরীক্ষা দিতে দিতে আমরা মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলেছি। বানগঙ্গা থেকে যাত্রা শুরু করে চরণপাদুকা পার হয়ে গেলাম। এক সময় পথ দুভাগ হল – একদিকে আধকুঁইয়ারী যাবার রাস্তা, আরেক দিকে হিমকোটি হয়ে ভবন ( মন্দির ) যাবার রাস্তা। মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছে একটি কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইনের পিছনে আমরাও যোগ দিলাম। এখানে মন্দিরে দেওয়ার জন্য পুজোর উপকরন কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। আর কিছুটা এগিয়ে পুজো সামগ্রী ও পর্চি ছাড়া সবই লকারে রেখে দিলাম। নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে আরো একদফা পরীক্ষায় পাশ করে পর্চি দেখিয়ে অবশেষে প্রবেশ করলাম মূল ভবনে। কিছুটা এগোনোর পরে প্রসাদসামগ্রীর সাথে দেওয়া নারকেলটাও নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেলাম না। সেখানে একটি কাউন্টারে নারকেল জমা দিয়ে তার বিনিময়ে একটি টোকেন পাওয়া গেল। অবশেষে গুহামুখে প্রবেশের জন্য লাইন, আলো ঝলমলে শ্বেতশুভ্র গোলাকার এক সুরঙ্গ। আমরা উত্তেজনায় তখন কাঁপছি। দীর্ঘ পাঁচ ছয় ঘন্টা নানান চড়াই- উৎরাই পার হয়ে ও নিরাপত্তারক্ষীদের নেওয়া পরীক্ষায় পাশ করে অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণের জন্য প্রস্তুত। 

                         সবশেষে দর্শন। মাত্র কয়েক সেকেন্ড বরাদ্দ প্রতিজনের জন্য। তাতেই মন আনন্দে ভরে গেল। তথ্য ঘাটলে জানা যায় যে প্রতি বছর ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ভক্ত এখানে দর্শন করতে আসেন। গুহায় কোনো মূর্তি নেই। তিনটে শিলাখন্ড মাত্র। বামদিকে মহাসরস্বতী, ডানদিকে মহাকালী ও মাঝে মহালক্ষ্মী। দেবী পুরাণের মতে দেবী এখানে বৈষ্ণোদেবী। সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের অধিষ্ঠাত্রী। চোখে তার চন্দ্র ও সূর্য। বসন তারকাখচিত। মহিষাসুর ভৈরোনাথকে বধ করার জন্য দেবতারা দেবীর আট হাতে আটটা অস্ত্র দিয়েছেন। ভৈরোবধের পরে দেবী এই গুহায় আশ্রয় নেন। গুহাতে প্রবেশ করতেই অনুভব করলাম গুহার শান্ত, শীতল পরিবেশ। আমাদের দর্শনের সময় রাত্রি ২-২৫ হলেও ঘড়ির দিকে না তাকালে বুঝবার ক্ষমতা নাই কারো। দর্শন শেষে মন্দির প্রাঙ্গন থেকে বাইরে আসার পথে একটি কাউন্টারে প্রথমে টোকেন দেখিয়ে নারকেল ফেরত পেলাম। অন্য কাউন্টার থেকে মাতা বৈষ্ণোদেবীর প্রসাদ হিসাবে পাওয়া ছোট প্যাকেটে ভরা মিছরিদানা ও একটি আশীর্বাদী মুদ্রা আমাদের কাছে বাড়তি পাওনা। এখানে অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। রসিদের বিনিময়ে অনুদান দেওয়া যায় সব সময়তেই। ভৈরোনাথকে দর্শন করতে হলে আরো কয়েক কিমি চড়াই রাস্তা অতিক্রম  করে তবেই দর্শন মেলে। এবারে নেমে আসার পালা। পাহাড়ী পথে নেমে আসাটা কঠিন না হলেও সহজ কাজ নয়। ফিরবার পথে হিমকোটি থেকে অন্যপথে গিয়ে আধকুঁয়ারী দর্শন করে কাটরাতে নেমে আসা যায়। নামতে নামতে একসময় ভোরের আলোয় পাহাড়ের চূড়া স্পষ্ট হয়ে উঠল। নীচের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সদ্য জেগে ওঠা কাটরা শহরকে। আমরা রাতজাগা পাখীর মত ধীরে ধীরে পাকদন্ডী পথে নেমে চলেছি কাটরা বুকে।

                     কীভাবে যাবেনঃ কলকাতা থেকে হিমগিরি এক্সপ্রেস, জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস সরাসরি জম্মু যাচ্ছে । জম্মু থেকে কাটরা ঘন্টা দুয়েকের পথ (প্রায় ৫০ কিমি )। যদি নিউদিল্লী হয়ে যেতে চান তবে নিউদিল্লীগামী যে কোনো ট্রেনে এসে বিকেল ৫-৩০ এ সরাসরি কাটরা যাওয়ার ট্রেন হল শ্রীশক্তি এক্সপ্রেস ( ট্রেন নম্বর ২২৪৬১ ), দূরত্ব ৬৫৫ কিমি।

 কোথায় থাকবেনঃ স্টেশন রোড থেকে মূল বাজারের দিকে আসতে প্রচুর লজ গড়ে উঠেছে। বাসস্ট্যান্ড চত্বরের ১ কিমি দূরত্বের মধ্যে  প্রচুর থাকবার জায়গা। তার মধ্যে শ্রীহরিনিবাস, হোটেল ইন্দ্রপ্রস্থ, জিঞ্জার হোটেল, মা সরস্বতী ইত্যাদি।

 কখন যাবেনঃ সারা বছর দর্শন করা গেলেও শীতের সময় তাপমাত্রা অনেক নীচে নেমে যায় ও রাস্তা বরফে ঢেকে যায়। মনোরম সময় হলো মে মাস থেকে নভেম্বর মাস।

        বিশদ জানতে ‘মাতা বৈষ্ণোদেবী শ্রাইন বোর্ডের’ ওয়েবসাইটের সাহায্য নিতে পারেন।            www.maavaishnodevi.org

          

মন্তব্যসমূহ