পশ্চিম পাহাড়ে দাবানল, In spring Bastard teak ( Palash) flowers cover the whole forest, looks like fire in the tree
| PALASH FLOWER |
একটা দিনও সময় পাবে না ? বন্ধুর এই প্রশ্নে আর ‘না’ বলতে পারলাম না। দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি আমাকেও গ্রাস করছে, কিন্তু আমার মতো ছা-পোষা মানুষের পালাবার পথ নেই। তাই আগে অনেক বার বেড়াবার প্রশ্নে এড়িয়ে গেছি, কিন্তু এবার যে একদিন, তাই .........।
সময়টা বাংলার চৈত্রমাসের মাঝামাঝি। প্রতিদিনের একঘেয়েমি
জীবনের নাগপাশ কেটে হঠাৎ করেই সদলবলে বেড়িয়ে পড়লাম। আসানসোল, দিসেরগড়কে পিছনে ফেলে
পৌঁছে গেলাম পারবেলিয়া মোড়।
সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরল আমাদের গাড়ী। এতটা চলে আসার
পরেও আশা নিরাশার দোলাচলে দুলছি সবাই। শেষ পর্যন্ত সাধপূরণ হবে তো ? আসলে সেই কাকভোরে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে এতটা ছুটে
এসেছি শুধুমাত্র রক্তিম পলাশ ফুলের টানে। শর্বরী মোড় পৌঁছে আমাদের ড্রাইভার হারু
গাড়ীর জানলা থেকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিল – এখান থেকে বড়ন্তি কতটা ? উত্তর এলো – মাত্র
কয়েক কিলোমিটার। সামনের রাস্তাটা খারাপ , সেটা দিয়ে খানিকটা এগোতেই হঠাৎ সামনের দৃশ্যপট
পালটে যেতে লাগলো। প্রথমে ঝোপ দিয়ে শুরু
হলেও ধীরে ধীরে বড় গাছের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো।
মনে হলো আমরা কোনো জঙ্গলে প্রবেশ করছি। মনে হওয়া নয় , বুঝলাম শাল, মহুয়া,
পলাশের জঙ্গলের মধ্যিখানের রাস্তা দিয়ে
চলেছি। রাস্তাটা বেশ সরু। সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে। দুপাশের গাছপালার পাতা
খসানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। তাই জঙ্গলের মাটি বিবর্ণ শুকনো পাতা ও ঝরে পড়া কোমল লাল
পলাশে ঢাকা। পথে লোকজন প্রায় নেই ।
![]() |
| WAY TO BARHANTI, PURULIA |
একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে আমাদের গাড়ী থামালাম। ডানপাশের জঙ্গলটা শুধুই পলাশের। গাছগুলোতে পাতা প্রায় নেই বললেই চলে। ন্যাড়া গাছে শুধুই লাল পলাশ। বয়ে চলা হালকা মৃদু বাতাস আমাদের কাছে প্রকৃতির আদরের পরশ মনে হচ্ছে। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। হাতের ক্যামেরাতে ডিজিটাল ছবি তোলার সাথে সাথে মন ক্যামেরাতেও স্মৃতির পাতা সমৃদ্ধ হচ্ছে। একটু এগুতেই গাছের তলায় পড়ে থাকা শুকনো পাতায় পা পড়ে খরখর আওয়াজ উঠল ও তাতেই কয়েকটা সুন্দর দেখতে পাখীর আড্ডা পণ্ড করে দিলাম।
সামান্য জলযোগ করে আবার এগিয়ে চললাম। রাস্তার দুইপাশে বিভিন্ন শেডের সবুজ ও তাতে আগুন রঙা ফুল। তারই বুক চিরে কোলাহলহীন কালো পীচ রাস্তা। মনোরম এই পথ ছেড়ে যেন আর এগুতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় সারাদিন পলাশবনে কাটিয়ে দিই। প্রায় জনমানবহীন এই রাস্তায় মাঝে মাঝে আদিবাসী মহিলারা শুকনো পাতা, ডাল সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছেন। তাদের কাছে এই অচেনা জায়গার কিছু কথা জেনে নিচ্ছি। না গুগল এখনো এই রাস্তার ফুল, পাতা, পাখি, মানুষের খবর দিতে পারে না।
গাড়ী আবার এগিয়ে চলল। দুপাশের জঙ্গল পিছনে
মিলিয়ে যেতে না যেতেই সামনে ম্যাজিকের মতো দৃশ্যপট বদলে গেল। বনের শেষে বাঁ দিকে বিশাল ফাঁকা জায়গা, তার ঠিক পরেই একটা পাহাড়। পাহাড়ের গা সবুজ গাছে ঢাকা হলেও পাদদেশে
পলাশবনের আগুন। মনে হচ্ছে সবুজ পাহাড়ে দাবানল দেখছি, সে এক অপূর্ব দৃশ্য ! দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্যের নরম হাত
আমাদের চোখের উপর বুলিয়ে দিচ্ছে। এতদিন পাইন, দেবদারু ঘেরা পাহাড় দেখে এসেছি।
কিন্তু এর সৌন্দর্য যেন অন্যরকম ! এ যেন গ্লসিপেপারে ছাপানো ঝকঝকে ছবি নয়, একটু রুক্ষতা মেশানো ম্যাট ফিনিশ করা বিশাল
বিশাল ছবি্র প্রদর্শনী দেখছি। চৈত্রের ঝড়ে যাওয়া পাতার সাথে আগুন রঙা পলাশ মাটিতেও
যেন লাল নরম গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। আমার দুই বন্ধু প্রকৃতির সাজানো লাল গালিচাতে
শুয়ে বসে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারল না। শিশু সুলভ দুষ্টুমি আজ হঠাৎ বড়দের মধ্যে
পেয়ে বসল।
![]() |
| BARHANTI, PALASH JUNGLE |
আবার এগিয়ে চলি, এখন ডানদিকে পাহাড়কে রেখে এগিয়ে চলেছি। এবার পলাশের জঙ্গল
পাতলা হয়ে শাল, মহুয়া, পিয়াল সংখ্যা বাড়তে
লাগলো। দূরে একটা হালকা সবুজ পাহাড়, তাকে ঘিরে বিশাল জলাশয়। হ্যাঁ, পৌঁছে গেলাম
বড়ন্তি। এযেন ছেলেবেলাতে নিজের পছন্দ করে আঁকা আমার একটা ছবি।
জলের উপর দিয়ে বয়ে আসা শীতল হাওয়া সারা শরীরে আদুরে
হাত বুলিয়ে এতক্ষনের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছে। জলাশয়ের দর্পনে সবুজ পাহাড়ের
প্রতিচ্ছবি দেখে মনে হচ্ছে এই সৌন্দর্য উপহার দেওয়া শুধু প্রকৃতির পক্ষেই সম্ভব। বড়ন্তি
নদীর উপর বাঁধ দিয়ে তৈরী এই জলাধার। সারাদিন ঘুরেও এখানে বেড়াবার সাধ পূরণ হওয়ার
নয়। উদীয়মান সূর্য থেকে অস্তগামী সূর্যের সাত রঙ, পাহাড় , জলাশয়, সবুজবনকে
কাজে লাগিয়ে সারাদিন এখানকার
সৌন্দর্য আবর্তিত হয়। আমরা জলাশয়ের পাশ দিয়ে মেঠো পথ দিয়ে কিছুক্ষনের জন্য
হারিয়ে গেলাম।
| BARHANTI, PALASH FLOWER, PURULIA |
এবার গড়পঞ্চকোটের পথে। পাঞ্চেত পাহাড়ের কোলে এই মনোরম জায়গা। আমাদের প্রতিবেশী জেলা পুরুলিয়াতে পাহাড়, জলাশয়, সবুজবন, রঙ্গীন ফুল, নির্জনতা মিলেমিশে প্রকৃতির রূপ ও সৌন্দর্যের এত বৈচিত্র আছে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এসব ভাবতে ভাবতেই কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে চলে এসেছি। গড়পঞ্চকোটে চলে আসতেই বাঁদিকে পাহাড়, গায়ে তার বিভিন্ন শেডের সবুজ। তবে পলাশবনের দাবানল এখানেও যে আমাদের পিছু ছাড়েনি সেটা ডানদিকে তাকালেই মালুম হয়।
দুইপাশে ঘনসবুজ বনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে পেলাম পাহাড়ে ট্রেকিং করার প্রবেশপথ। এখান থেকে গাড়ী যাওয়া মানা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের অধীনে এই বনভ্রমণ করার জায়গা। প্রবেশমুখে নিয়মাবলি ও গাইডম্যাপ দেওয়া আছে। গেট থেকে তাকিয়ে দেখি হাঁটা পথ কিছুটা গিয়ে বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আমরা পাহাড়ি পথে হেঁটে চলেছি। নাম না জানা ফুলের সৌন্দর্য, পাহাড়ি ঝর্ণার ছটপটানি দেখে মন জুড়িয়ে গেল। চারদিকে লম্বা লম্বা সবুজ বৃক্ষ। কারো কারো পুরোনো পাতা ঝড়ে গিয়ে চকচকে সবুজ পাতায় জেল্লা দিচ্ছে। নির্জন, নিঃস্তব্ধ এই জঙ্গলে কান পাতলেই সবুজপাতার মধ্যে বয়ে চলা বাতাসের ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছি। মুখ তুলে তাকাতেই অবাক হই আকাশ এত নীল ! আগে তো দেখিনি কোনোদিন। পথেই পেলাম প্রাকৃতিক বিশ্রামাগার। যতই এগিয়ে চলি অবাক না হয়ে পারা যায় না। তাই একবার এসে মন ভরলো না, আরো একবার আসতেই হবে। এবারের মতো বিদায় , আবার দেখা হবে তোমার সাথে , আসব আবার লাল পলাশের দেশে।


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন