সতীপীঠের আলোয় বীরভূম, Out of 51 Satipiths 5 Satipiths are in Birbhum of West Bengal

                             

                     খুব বেশী বাড়িয়ে বলা হবে না যদি বীরভূম জেলাকে  দেবভূমি বলা হয় অসংখ্য পুরানো মন্দিরের আলোয় আলোকিত থাকার পরেও ৫১ টি সতীপীঠের পাঁচ পাঁচটিই বীরভূমের নানান জায়গায় ছড়িয়ে আছে। পৃথিবীর আর কোনো জায়গা নেই যেখানে এতগুলো সতীপীঠ একসাথে আছে। তাই শুধুমাত্র সতীপীঠ দর্শন করার জন্যই সামনের কটা দিন আপনার অস্থায়ী ঠিকানা হতে পারে এই লালমাটির দেশে।

                  অনেকেরই  জানা থাকলেও আর একবার লিখছি সতীপীঠস্থান কিভাবে গড়ে উঠেছিল। দক্ষরাজা এক সুবিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে সকলে নিমন্ত্রিত থাকলেও দক্ষকন্যা সতী ও তার  স্বামী শিবের সেখানে কোনো নিমন্ত্রন ছিলো না। স্বামীর অমতেই সতী যজ্ঞস্থলে যান এবং সেখানে অপমানিত হন। সভাস্থলে পতিনিন্দা সইতে না পেরে সতী প্রাণত্যাগ করেন। এরপর সতীদেহ কাঁধে নিয়ে মহাদেবের প্রলয়, অবশেষে বিষ্ণুর চক্রে সতীদেহ খন্ড খন্ড হয়ে ৫১ টি জায়গায় গিয়ে পড়ে। গড়ে ওঠে ৫১ টি পবিত্র সতীপীঠস্থান। নলহাটি, সাঁইথিয়া, বক্রেশ্বর, কংকালীতলা, লাভপুর – এই  হলো বীরভূমের পাঁচ পবিত্র সতীপীঠ।

  নলহাটিঃ


   SATIPITH  NALHATI, BIRBHUM, A  SPIRITUAL TOURIST SPOT     SATIPITH NALHATI, BIRBHUM, A DEVOTIONAL TOURIST SPOT                        নলহাটি দর্শনের মধ্যে দিয়ে আপনি আপনার এই ভ্রমণ শুরু করতে পারেন এইখানেই আছেন মা নলাটেশ্বরী। মন্দিরের প্রবেশপথে সামনেই  বিশাল সুন্দর তোরন, এটা অতিক্রম করলেই একটা বিশাল চত্বর। মূল মন্দিরটি একটি টিলার উপর অবস্থিত। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে তবেই দেবীর দর্শন মেলে। এখানে সতীর নলা (সরু হাড়) পড়েছিল। পৌরাণিক মতে দেবী এখানে কালিকা নামে বিরাজমান, শিব যোগেশ ভৈরব নামে প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরে দেবীর কোন মূর্তি নাই। লালরঙের  শিলাখন্ডই দেবীরূপে পূজিত হন। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমস্ত সতীপীঠেই দেবী শিলারূপে পূজিত হন। কোথাও কোনো বিগ্রহ নাই, আকারহীন শিলাই এখানে সব মনে করা হয় দেবীর দেহাংশ মাটি স্পর্শ করা মাত্র শিলায় রূপান্তরিত হয়। মন্দিরে নিত্য পুজোর পাশাপাশি  অন্নভোগ খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে    

থাকবার জায়গাঃ নলহাটিতে থাকবার জায়গা থাকলেও রামপুরহাট বা তারাপীঠে রাত্রিবাস করাই ভালো

হাতে সময় থাকলেঃ  নলহাটি থেকে কয়েক কিমি দূরত্বের মধ্যে থাকা আকালীপুর ঘুরে আসতে পারেন। মহারাজ    নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত সর্পভূষনভূষিতা গুহ্যকালী দেখবার মতো। কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত এই কালীমূর্তি ভারতবর্ষে আর কোথাও নাই


  সাঁইথিয়াঃ                 

SATIPITH SAINTHIA, NANDIKESWARITALA, BIRBHUM, A FAMOUS DEVOTIONAL TOURIST SPOTSATIPITH SAINTHIA, NANDIKESWARITALA, BIRBHUM, A FAMOUS DEVOTIONAL TOURIST SPOT
                          নলহাটি দর্শন করে চলে আসুন সাঁইথিয়াতে। নলহাটি থেকে ট্রেন যোগাযোগ যথেষ্ঠ ভালো অতীতে নন্দীপুর নামে পরিচিত এই স্থানে সতীর  কন্ঠের হাড় পড়েছিলো এখানে দেবীর নাম নন্দিনী, মহাদেব নন্দীকেশ্বর সাঁইথিয়া রেল স্টেশনের খুব কাছে এই মন্দির জায়গাটির নাম নন্দীকেশ্বরীতলা মূল রাস্তা থেকে নেমে প্রথম প্রবেশদ্বার পার হয়ে বেশ প্রশস্ত একটা জায়গা মাঝে একটি গোল ঘেরা জায়গাতে কয়েকটি ঘোড়ার মূর্তি শোভা বৃদ্ধি করছে চারদিকে বসবার চেয়ার দেওয়া আছে এরপর মূল মন্দিরের প্রবেশদ্বার সব সতীপীঠস্থানের মূল প্রবেশদ্বারের গঠন ও সজ্জা  একই রকম প্রবেশপথের পাশেই  জগন্নাথদেবের সুন্দর মন্দির দেবীর মন্দিরের ভিতরে একটি লাল শিলাখন্ড দেবীরূপে পূজিত হয় পাশেই এক প্রকান্ড ও প্রাচীন বটগাছ, গাছের গোঁড়াকে নিয়ে ঘিরে বাঁধানো এই মন্দির মন্দিরের প্রাচীরের ভিতরের দেওয়ালে দশমহাবিদ্যার নানান মূর্তিগুলি বেশ নজর কারে এখনো তেমনভাবে প্রচার না পাওয়ায় বাইরের ভক্ত সমাগম কম, স্থানীয়রা বেশী এখানে থাকবার ও ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা আছে সকাল সকাল মন্দিরের পুরোহিতের সাথে যোগাযোগ করে ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়   

থাকবার জায়গাঃ  সাঁইথিয়াতে থাকবার মতো কয়েকটা লজ পাওয়া গেলেও সংখ্যায় ও মানে নগন্য দর্শন শেষে সিউড়িতে রাত্রিবাস করা ভালো হবে

হাতে সময় থাকলেঃ  সাঁইথিয়া থেকে মাত্র ১০ কিমির মধ্যে দেখে নিতে পারেন মদনেশ্বর শিব মন্দির ও আরো একটু দূরে কলেশ্বরের শিব মন্দির


বক্রেশ্বরঃ 

SATIPITH BAKRESWAR, BIRBHUM, FAMOUS DEVOTIONAL TOURIST SPOT, FAMOUS FOR  HOT SPRINGSATIPITH BAKRESWAR, BIRBHUM, FAMOUS TOURIST SPOT, HOT SPRING

                                  দর্শন শেষে সাঁইথিয়া থেকে চলে আসুন বীরভূমের সদর শহর সিউড়িতে। মাত্র ১৮ কিমি দূরের এই শহরের সাথে ট্রেন যোগাযোগ থাকলেও বাসেই সিউড়ি যাওয়া সুবিধা সিউড়িকে কেন্দ্র করে দেখে নেওয়া যায় আরো এক সতীপীঠ বক্রেশ্বর এখানে দেবীর ভ্রুসন্ধি পতিত হয় দেবী এখানে মহিষমর্দিনী ও ভৈরব বক্রনাথ নামে বিরাজিত সতীপীঠস্থান ছাড়াও এর এক অন্য আকর্ষণ হচ্ছে উষ্ণপ্রস্রবন বা গরমজলের ঝর্ণা এখানে পুরুষ ও মহিলাদের আলাদাভাবে স্নানের ব্যবস্থা আছে এই ঝর্ণার জলে পেটের রোগ সেরে যায় এখনো জল নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা   

থাকবার জায়গাঃ         বক্রেশ্বরে কিছু লজ গড়ে উঠলেও রাত্রিবাসের সেরা জায়গা সিউড়ি

হাতে সময় থাকলেঃ    হাতে সময় থাকলে কয়েক কিমি দূরে পাথরচাপুড়িতে দাতাবাবার মাজার দর্শন করে নেওয়া যায়


 কংকালীতলাঃ

     SATIPITH KANKALITALA, BIRBHUM, FAMOUS DEVOTIONAL TOURIST SPOT    SATIPITH KANKALITALA, BIRBHUM, FAMOUS DEVOTIONAL TOURIST SPOT     

             বক্রেশ্বর দর্শন শেষ করে সিউড়িতে রাত্রিবাস, পরদিন সকালে সিউড়ি থেকে ৩০ কিমি দূরে বোলপুরে চলে আসুন বোলপুরকে কেন্দ্র করে ঘুরে নিন কংকালীতলা ও লাভপুর বোলপুর থেকে সকালে চলে আসুন কংকালীতলায় দূরত্ব ৮ কিমির মতো কংকালীতলাই হল আরো একটা সতীপীঠ, যদিও এইসব জায়গা প্রচারের আলোর বাইরে থেকে গেছে। প্রধান সড়ক রাস্তা থেকে সুন্দর এক তোরনের মধ্যে দিয়ে সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে মন্দিরের গেট পর্যন্ত। ডানপাশে পূজাসামগ্রী যেমন সিঁদুর, জবার মালা, ধূপ, প্রদীপ, প্রসাদের মিষ্টি বিক্রীর সারিসারি দোকান। বাঁদিকে ফাঁকা মাঠের মতো,একটা  ব্যাগ, মালা, চূড়ির  দোকান, আর একটা পুরিসব্জী, চায়ের দোকান। বাকী অংশে বড় গাছের ছায়ায় গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থা আছে। মন্দিরের পাশেই একটি ছোট জলাশয় আছে। এই জলেই নাকি পড়েছিলো দেবীর কাঁখ। পবিত্র এই জলাশয় নোংরা করা মানা। মূল মন্দির বেশ ছোট। এখানে একটি বাঁধানো শ্মশানকালীর  ছবিকে দেবী হিসাবে পূজা করা হয়। মন্দিরের বাইরে জায়গা অনেকটা, একটি প্রাচীন বটগাছের তলায় বলিদান করার ব্যবস্থা। একটু দূরে ভোগমন্দির। এখানে ৪০ টাকার বিনিময়ে ভোগ খাবার ব্যবস্থা আছে। সকালে যোগাযোগ করতে হবে এই ফোন নম্বরে -  ৮৭৫৯২৩০৫৭৩

এখানকার প্রাকৃতিক শোভা মনোরম, খানিকটা দূর দিয়ে সবুজের বুক চিরে বয়ে চলেছে কোপাই নদী।

থাকবার জায়গাঃ  বোলপুর, শান্তিনিকেতনে প্রচুর থাকবার লজ আছে  

হাতে সময় থাকলেঃ  হাতে সময় থাকলে দেখে আসতে পারেন খোয়াই এর হাট। গ্রামীন এই হাটে আপনি পাবেন শান্তিনিকেতনে তৈরী ব্যাগ, চাদর, ঘর সাজাবার সামগ্রী। বল্লভপুর অভয়ারন্যতে হরিণ দেখে নিতে ভুলবেন না। আর যারা কবিগুরুর স্মৃতিবিজরিত শান্তিনিকেতন আগে দেখেন নি তাদের তো দেখে যেতেই হবে।   

 

  লাভপুরঃ         

SATIPITH FULLARA, LAVPUR, BIRBHUM, FAMOUS DEVOTIONAL  TOURIST SPOTSATIPITH FULLARA, LAVPUR, BIRBHUM, FAMOUS DEVOTIONAL  TOURIST SPOT
            বোলপুরে রাত্রিবাস করে পরের দিন সকালে যাত্রা করুন লাভপুর এখানে সতীর ঠোঁট  পতিত হয় এখানে দেবী ফুল্লরা ও ভৈরব বিশ্বেশ্বর নামে বিরাজিত এখানে মন্দিরটি খুব সুন্দর এক বিরাট লাল পাথর দেবী রূপে পূজিত হন এখানে পূজার উপকরণ বিক্রীর সেই রকম দোকানপাঠ না থাকায় বাইরে থেকে কিনে নিয়ে এলে ভালো হয় এখানেও অন্নভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা আছে, তবে খুব সকালে এসে যোগাযোগ করতে হবে বর্তমানে মন্দিরের কাছে একটি অতিথিনিবাস হয়েছে। থাকবার জন্য যোগাযোগ-  ৯৪৩৪৩৪৮২৩০, ৯৪৩৪৩৪৮৪৮২।

থাকবার জায়গাঃ   বোলপুর- শান্তিনিকেতন

হাতে সময় থাকলেঃ  বিখ্যাত সহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মভিটা ( বর্তমানে একটি মিউজিয়ম ) , হাঁসুলিবাঁক দেখে নেওয়া যায়।

কখন যাবেনঃ  গ্রীষ্মকালে বীরভূমের তাপপ্রবাহ এড়িয়ে বাকী যে কোনো সময় আসা যাতে পারে

 যোগাযোগঃ     হাওড়া থেকে নলহাটী আসার সরাসরি ট্রেন

১৩০১৭ গণদেবতা এক্সপ্রেস,  ৫৩০৪১ হাওড়াজয়নগর প্যাসেঞ্জার,  ৫৩০৪৩ হাওড়া- রাজগীর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার,   ১৩০১১ হাওড়া- মালদা টাউন ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস


মন্তব্যসমূহ