মিনি গুলমার্গ - সানাসার , The beauty of Sanasar is just like Gulmarg of Kashmir
![]() |
| A VIEW OF PATNITOP |
কাটরা থেকে প্রায় ৯০ কিমি দূরে পাহাড়ের গায়ে ছবির মতো সুন্দর গ্রাম পাটনিটপ। জাতীয় সড়ক ধরে পাটনিটপ যাওয়ার পথে আমরা নানা
অজানা জায়গার সাথে সাথে অতিক্রম করে গেলাম নামের সাথে অতি পরিচিত জায়গা উধমপুর ও
কুদ। এরপর গাড়ী ডানদিকে ঘুরে পাহাড়ী পেঁচানো পথে উঠতে উঠতেই বাইরের শীতল হাওয়া
গাড়ীতে ঢুকে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। জানান দিল যে আমরা ২০২৪ মিটার উচ্চতায়
অবস্থিত মনোরম শৈলাবাস পাটনিটপে পৌঁছে গেছি। কাটরা থেকে আসতে সময় লাগলো ঘণ্টা
চারেক।
![]() |
| A VIEW FROM PATNITOP TO SANASAR |
আমদের
হোটেলটা পাহাড়ের অনেকটা উপরের দিকে। এখানে পৌঁছে মনে হচ্ছে সমগ্র জায়গাটি যেন এক
মস্ত ভিউপয়েণ্ট। যে দিকেই তাকাই না কেন যেন সবুজ একটা ছবি দেখছি বলে মনে হচ্ছে।
শান্ত, শীতল এইস্থানে পাইনের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা বাতাসের আওয়াজ, দৃষ্টির বাইরে
থাকা পাখীর ডাক, কোন কিছুই আমাদের কানকে ফাঁকি দিয়ে যেতে পারছে না।বেলা ৩-৩০ নাগাদ
আমাদের দুপুরের খাওয়া শেষ হলো। আমরা শীতল পাহাড়ী পথে হাঁটতে শুরু করলাম। দু’পাশের
সারিবদ্ধ পাইন গাছ পথকে আরো ছায়াময় ও শীতল করে তুলেছে। কিছুটা হেঁটেই আমরা পৌঁছে
গেলাম পার্কের মতো একটি ঘেরা জায়গায়। দেখে মনে হলো এ যেন থিম সবুজ। চারদিকে নরম
সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো। ঢেউ খেলানো জায়গা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে পাহাড়ের উপরে গিয়ে মিশেছে। কাশ্মীরি
গালিচার গায়ে থাকা সূক্ষ্ম নক্সার মতো এখানে সবুজ ঘাসের গালিচাতেও রয়েছে প্রকৃতির
হাতে তৈরী নানান কারুকার্য। অসংখ্য হলুদ ও সাদা রঙ এর ফুল সবুজ গালিচার গায়ে এই
কারুকার্য ফুটিয়ে তুলেছে। পাহাড়ের ঢালু হয়ে যাওয়া গা কেউ যেন সাজিয়ে তুলেছে সারি
সারি পাইন গাছ দিয়ে। তার সাথে মানানসই পাথরের সিঁড়ি ও সবুজ কটেজ। জম্মু ও কাশ্মীর
ট্যুরিজমের তৈরী এই কটেজগুলি পাহাড়ের ঢাল বরাবর সাজানো। চোখের ও মনের তৃপ্তি
মেটানোর জন্য আদর্শ স্থান হলো এই পাটনিটপ। কয়েকদিন নিরিবিলি প্রকৃতির কোলে কাটাবার
জন্য এই কটেজগুলোর তুলনা নেই। পাহাড়ের আরো উপরের দিকে আপেলের বন আছে। ঘোড়ায় চড়ে
আপেল বন দেখার মজাই আলাদা। তবে সময় ও শরীর সাথ দিলে পায়ে হেঁটেও চারদিক ঘুরে নেওয়া
যায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই এখানকার মূল
সম্পদ। সেই টানেই সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ বহূ দূর থেকে ছুটে আসেন এখানে।স্থানীয়
বাসিন্দারা সাপ্তাহিক ক্লান্তি বিসর্জনের জন্য মনোরম এই জায়গাকে বেছে নিয়েছেন।
যতদূর জানা যায় ‘পাটনিটপ’ শব্দটি সম্ভবত এসেছে ‘পাটান দা তালাও’ (অর্থ্যাৎ
রাজকন্যার পুকুর ) থেকে। বহূপূর্বে নৈসর্গিক শোভামন্ডিত
এই স্থানে এক তালাও বা জলাশয় ছিলো। কথিত এখানকার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে রাজকন্যা
রাজবাড়ীর বিলাসবহূল স্নানাগার ছেড়ে এখনে আসতেন স্নান করতে।এরপর বহুদিনের ব্যবহারে
এই জায়গার নাম লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে পাটনিটপ নামে পরিচিত হয়েছে।শিবালিক হিমালয়ের
কোলে অবস্থিত এই শৈলাবাস যে কতটা প্রাচীন তা এখানকার ৬০০ বছরের প্রাচীন নাগমন্দিরটি
দর্শন করলেই অনুভব করা যা্য়।বছরের অন্য সময় সবুজ পাটনিটপ দেখতে পাওয়া গেলেও শীতের
সময় বরফের চাদর মুড়ি দেয়।তখনকার রূপ আবার ভিন্ন। তাই সারা বছরই ফটোগ্রাফারদের স্বর্গরাজ্য এই জায়গা।
পাটনিটপ থেকে দেখলে সামনে পাহাড়ের
গায়ে সাজানো জনপদটাকে সুন্দর ছবির মতো দেখায়। আমাদের ড্রাইভার আমন ভাই চেনালো – এই
সুন্দর জনপদটার নাম কুদ। আবার এই পাহাড়ের ঠিক পিছনে নাকি রয়েছে এক অপরূপ জায়গা –
সানাসার। তখনই ঠিক হলো পরের দিন সকালে আমরা যাব সানাসার। পরিকল্পনা মাফিক আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে সানাসারের দিকে রওনা হলাম।পাটনিটপ থেকে মাত্র ২০ কিমি।
কিছুটা এগোনোর পরেই পেলাম নিরিবিলি পাহাড়ী পথ। পথে অন্য কোন যানবাহন নেই। গাড়ী
চালাতে চালাতে আমন ভাই আমাদের সাথে পরিচয়
চলে পাইন, দেওদার গাছের। অত্যন্ত মনোরম এই পথ। যানবাহনহীন পথে আমাদের গাড়ী মাঝে
মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে অগণিত ভেড়া ও ছাগলের মিছিলের পিছনে। এক একটা দলে প্রায়
পাঁচশত থেকে ছয়শত ভেড়া ও ছাগল চললো। সাথে পুরো পরিবারকে উঠিয়ে একস্থান থেকে অন্য
স্থানে চলেছে যাযাবরের দল। দৈনন্দিন জীবনের দরকারী জিনিষপত্র নিয়ে বাচ্চা ছেলে
মেয়েরা ঘোড়ায় চড়ে দিব্যি চলেছে অজানার পথে। নিষ্পাপ, দুশ্চিন্তামুক্ত শিশুমুখ
সহজেই নজর কারে আমাদের। মজার ব্যাপার প্রত্যেক দলের সাথে
গলায় ফিতে বাঁধা একটি কুকুর রয়েছে। আমন ভাইয়ের কাছে জানলাম এইসব মানুষরা পশুপালন
করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছাগল ও ভেড়ার খাওয়ার উপযোগী সবুজ ঘাস যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই এরা এদের অস্থায়ী বাসা
বাঁধবে। পথে যেতে যেতে এদের থাকবার ঘরবাড়ীর সাথেও আমরা পরিচিত হলাম। ঘরগুলি নীচু,
পাহাড় লাগোয়া, মাটির তৈরী, ছোট ছোট জানলা ও দরজা। অনেকে ছাদের উপর মাটি ফেলে সব্জী
চাষ করছেন। বার বার ছাগল ও ভেড়ার কাছে বাঁধা পেয়ে আমরা অবশেষে পৌঁছালাম সানাসার।
এখানে এতো কম পর্যটক আসেন যে কৃত্রিমতা এখনো প্রকৃতিকে গ্রাস করতে পারেনি। গাড়ী
থেকে যেখানে নামলাম সেখান থেকে রাস্তাটা ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। একটু এগোলেই সামনের দৃশ্যপট চোখের আরাম এনে দেয়।
তিনদিক ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। তার উপর প্রায় নিঁখুত নরম ঘাসের কার্পেট পাতা। আসলে
এটি একটি কাপ আকৃতির বিশাল তৃণভূমি। একদিকে পাইন বন। মাঝে সানাসার লেক। প্রাকৃতিক
এই লেকের চারধার বাঁধানো। বসবার জন্যও সুন্দর ব্যবস্থা আছে লেকের ধার বরাবর।
সৌন্দর্যের জন্য সানাসার ‘মিনি গুলমার্গ’ নামেও পরিচিত। পায়ে পায়ে ঘোরার একটা
আনন্দ ও স্বাধীনতা থাকলেও এখানে ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি দেখার জায়গা ঘোড়ায় চড়ে দেখাই
সুবিধাজনক। ২০৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই জা্য়গায় পর্যটক বলতে আমরা ছাড়াও আরো
একটি পরিবার। এখনো সেভাবে থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এখানে কিছু সময়
কাটিয়ে আমাদের গাড়ী আবার ছুটলো, পৌঁছালাম নাথা টপে। এই টপ থেকে উত্তরের তুষারাবৃত
পর্বতমালার সৌন্দর্য আমাদের সকলের মন জয় করে নিলো। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি শীতকালে
সেইসব জায়গা বরফের তলায় চলে যায়। এখন শুধুই রকমারী সবুজ ও গবাদী পশুর
চারণভূমি।ক্যামেরার শাটারের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ এখানে কানে আসে না। এবার
পাটনিটপ ফিরে আসার পালা। এবারের মতো ছোট্ট ভ্রমণ
শেষ।পরের দিন লাঞ্চ সেরে আমরা চললাম জম্মুর পথে। ফেরার পথে একবার থামলাম
কুদে।এখানকার মিষ্টি বিখ্যাত। তবে সব সেরা হল নির্ভেজাল ঘিয়ে ভাজা পাতিজা। একবার
মুখে দিলেই আজীবন মনে থেকে যাবে কুদের কথা।অবশেষে জম্মু রেল স্টেশন। ফেরার পথেই
পরিকল্পনা শুরু পরবর্তী ভ্রমণের।



মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন