আমার স্বপ্নের সৈকত, গোয়া, Goa means world best beaches, Portuguese architecture, culture
| PALOLEM, GOA |
এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, আমার বহু দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। এবারের বড় দিনের ( ২৫ শে ডিসেম্বর ) ছুটি কাটাব গোয়াতে। কিন্তু জল ঢেলে দিল অমরাবতী এক্সপ্রেস, প্রায় আট ঘন্টা লেট। নেমে গেলাম মাড়গাওতে। বড়দিনের বিকেলটা স্টেশনেই কেটে গেল। সেখান থেকে গাড়িতে পানাজীর লজে আসতে আসতে সন্ধ্যে নেমে গেল।
এক কাপ কফি হাতে পাঁচ তলার
ব্যালকনিতে বসে আছি। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ঘড়ি না দেখলে সঠিক সময় অনুমান করা কঠিন।
আসেপাশের সমস্ত হোটেল, পানশালা, চার্চ, রাস্তা আলো দিয়ে সাজানো। সামনে মাণ্ডবী
নদীতে এখনো ক্রুজগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো। তার থেকে ছড়িয়ে পড়া
আলোয় জলের ঢেউ ঝিকমিক করছে। এত দূরেও গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। বোঝাই যায় ক্রুজের মধ্যে
গানের তালে উদ্দাম নৃত্য ও রঙীন পানীয়র ফোয়ারা চলছে। শুনেছিলাম গোয়ায় রাত হয় না।
আজ নিজের চোখে দেখলাম। ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা যখন অন্য জায়গায়, তখনও এখানে
বেশ ফুরফুরে বাতাস।
| CRUISE ON MANDOVI RIVER, GOA, PANAJI |
১৯৮৭ সালে পূর্ণ
রাজ্যের মর্যাদা পায় ভারতের ২৫তম রাজ্য গোয়া। জায়গাটি আয়তনে ছোট হলেও পৃথিবীর সমস্ত ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে
আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। কারণ একটাই , এর অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
পূর্বে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, পশ্চিমে অনন্ত নীল জলরাশি নিয়ে আরব সাগর, মাঝে উত্তর
দক্ষিণ বরাবর ১০৪ কিমি দীর্ঘ সৈকত সোনালী
বেলাভূমি ও নারকেল বীথি দিয়ে সাজানো। গোয়ার বুকে বয়ে যাওয়া
দুই নদী মান্ডোবী ও জুয়ারি এই জায়গাকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে। এছাড়াও এই জায়গা ৪৫০
বছরের পর্তুগীজ সংস্কৃতির নিদর্শনে সমৃদ্ধ। এই জায়গাকে ভালোভাবে উপভোগ
করতে হলে উত্তর গোয়া ও দক্ষিন গোয়া ভাগ
করে দেখে নিতে হবে।
| Basilica of Bom Jesus |
| Basilica of Bom Jesus, inside view |
সেই মত পরিকল্পনা করে আমরা সকাল বেলায় ব্রেকফাস্ট করেই দক্ষিণ গোয়ার সৌন্দর্যে ডুব দিলাম। যাত্রা পথে এটা অনুভব করলাম , একই সঙ্গে পাহাড়ী রাস্তায় চলার উন্মাদনা ও সোনালী বেলাভূমির আনন্দ নেওয়া বোধহয় গোয়াতেই সম্ভব। দক্ষিন গোয়ার সমুদ্র সৈকত দর্শন শুরু করলাম কোলভা সৈকতের বেলাভূমি ছুঁয়ে। তবে আরব সাগরের নোনা জলের স্পর্শ পেতে আমাদের অনেকটা বেলাভূমি অতিক্রম করতে হল। পানাজী থেকে ৪০ কিমি দূরে চওড়া বালুতটের এই সৈকতে ওয়াটার স্কুটার, প্যারাসেলিং সবই মজুত। কোলভাতে মন ভরে আনন্দ করে চলে এলাম ডোনাপাওলাতে । এটি একটি সুন্দর ভিউ পয়েণ্ট। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতি মনোরম। ভিউ পয়েন্ট থেকে বহুদুর পর্যন্ত সাগর ও তার পাথুরে সৈকতের হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন। এখান থেকে আস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভার প্রতিফলন বড়ই মনোরম। বাম দিকে ডোনাপাওলার মূর্তি শোভা পাচ্ছে। ফেরার পথে মীরামার সৈকতকেও আমরা একবার ছুঁয়ে এলাম। শহর ঘেষা এই সৈকত প্রায় দুকিমি লম্বা। কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে তাকে বিদায় দিয়ে চলে এলাম সুসজ্জিত রাস্তায়।
ফিরে এলাম নিজের হোটেলে, হালকা চা-কফিতে চুমুক দিয়ে আবার ভেসে পড়লাম মান্ডবী নদীর জলে। এখানে পর্যটকদের স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করে থাকে একাধিক বিভিন্ন রকমের ক্রুজ, আমাদের টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল প্যারাডাইস ক্রুজে। উঠে থেকেই দেখি নানান সম্ভার, খাবার, ড্রিঙ্কস ইত্যাদি। নাচ, গান, খাবার , হৈ চৈ করে ঘণ্টাখানেক ভেসে থাকার আনন্দ হয়ে থাকল আমাদের সারা জীবনের সঞ্চয়। সারাদিনের আনন্দময় পরিশ্রম যে শরীরে ক্লান্তি আনে না, শরীর আরো সতেজ করে তোলে তার প্রমান রাত্রে পেলাম।
পরদিন সকাল থেকেই সাজো
সাজো রব , যাব উত্তর গোয়া। উত্তর গোয়ার আকর্ষনীয় সৈকতগুলির মধ্যে কয়েকটি হল –
কালানগুটে, বাগা, আঞ্জুনা, ছাপোড়া,ভাগাতোর, আরামবোল। আমরা প্রথমেই চলে এলাম উত্তর
গোয়ার ব্যস্ততম ও সবচেয়ে সুন্দর ক্যালাঙ্গুটে সৈকতে। পানাজি থেকে পনেরো কিমি দূরে “সৈকত রাণী”
কালানগুটের অবস্থান। ধনুকাকৃতি এই সৈকতের বেলাভূমিতে সাজানো সারি সারি হেলানো রঙীন চেয়ার।
সেখানে রৌদ্রস্নানে ব্যস্ত স্বল্পবসনা বিদেশীনিরা। সামনে
সামুদ্রিক মাছের লোভনীয় পদ ও পানীয়র রঙীন বোতল।
পিছন দিকে সারি সারি কটেজ। হৈ হুল্লোর ও ব্যস্ততায় জমজমাট এই সৈকত সবাইকে আকর্ষণ করবেই। যারা
প্রাকৃতিক শোভার পাশাপাশি হৈ হুল্লোর, দোকান , বাজার পছন্দ করেন, তাদের জন্য আদর্শ
জায়গা কালাঙ্গুটে সৈকত।
| VAGATOR BEACH, GOA |
| ANJUNA BEACH, GOA |
এরপর কিছুক্ষন গাড়ি যাওয়ার পর আমারা এসে পৌঁছলাম একটা জায়গায়, গাড়ী থেকে নামার পরে বুঝলাম এটা একটা পাহাড়ের উপর আমরা আছি। সেখান থেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে নামতেই দেখি একটা একটা সৈকত, যাতে বালি নেই গোটাটাই পাথুরে। দেখে মনে হয় এক বিশাল কালো পাহাড় সমুদ্রে স্নান করতে নেমেছে যার মাথাটা জলের উপর দেখা যাচ্ছে। শুনে ছিলাম গোয়ার এক একটা সৈকতের সৌন্দর্য নাকি এক এক রকম। এখন দেখে বুঝছি কথাটা কতটা সত্যি। আঞ্জুনার বিস্ময় কাটতে না কাটতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ভাগাতোর সৈকতে। রাস্তা থেকে ঠিক বোঝা যায় না কিছু আছে কিনা। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যেটা দেখছি সেটা কোন ক্যানভাসে আঁকা ছবি না সত্যি ? সামান্য বেঁকানো ধনুকের মতো সৈকত , দূরে একটি পাহাড় যেন আদর করে সমুদ্রের বুকে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। সোনালী বেলাভূমির মাঝে মাঝে জেগে উঠেছে কালো পাথর। সেখানে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে ঢেউগুলোর সৈকতের শেষ অবধি পৌঁছাবার স্বপ্ন। একদম পিছনে নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা এই সৈকত। জলের ছোঁয়া পেতে একটু নামতেই হল, যদিও এখানে স্নান করা নিষেধ আছে।
শুধুমাত্র সমুদ্র ও
সৈকত দেখার একঘেয়েমি কাটাতে আমরা একদিন চলে এলাম ওল্ড গোয়াতে । গোয়ার অন্যতম
বিখ্যাত সৌধ ব্যাসিলিকা অব বোম জেসাস এখানেই অবস্থিত। অপূর্ব সুন্দর এই চার্চটি
১৫৯৪ সালে তৈরি শুরু হয় ও নিবেদিত হয় ১৬০৫ সালে। বিশাল আয়তনের প্রার্থনা ঘরে একটি
শিশু যিশুখ্রীষ্টের মূর্তি আছে। এই চার্চের মূল আকর্ষণ সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের
দেহাবশেষ। প্রতি বছর ৩রা ডিসেম্বর এই দেহকে ঘিরে উৎসব পালিত হয়। ব্যাসিলিকার একদম
উল্টোদিকে শ্যে ক্যাথিড্রাল। এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাথিড্রাল। সারা গোয়া জুড়েই
প্রচুর আকর্ষনীয় চার্চের ছড়াছড়ি। সেগুলি নানা জায়গায় যাতায়াতের পথেই দেখা হয়ে গেল।
তবে গোয়াতে শুধু চার্চ নয়, পোনডাতে মঙ্গেশি মন্দির ও শান্তাদুর্গা মন্দির দেখবার
মতো। চার্চ , মন্দির দেখার পর স্বাদ বদলালাম
আগুয়াদা ফোর্ট দেখে। সমুদ্র লাগোয়া এই ফোর্ট মুগ্ধ করার
মতো। পর্তুগিজরা ১৬১২ সালে ডাচ ও মারাঠা আক্রমনের হাত থেকে গোয়াকে রক্ষা করার জন্য
এই ফোর্ট নির্মান করেন। এখানে একটি লাইট হাউসও আছে। অতি
প্রাচীন এইসব স্থাপত্য না দেখলে গোয়া ভ্রমণ অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যাবে।
যারা নির্জনতা পছন্দ করেন ও প্রকৃতির কোলে একরাত একান্তে কাটাতে চান তাদের প্রিয় সৈকত হল পালোলেম। পানাজি থেকে ৬৫ কিমি ও মারগাঁও থেকে ৪০ কিমি দূরে নির্জন এই দ্বীপ তুলনাহীন। আমরা পুরো একটা দিন সময় রেখেছিলাম পালোলেমের জন্য। অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই সৈকত ঘন সবুজ নারকেল গাছে সাজানো। দুদিকে দুটি পাহাড় সমুদ্রে প্রবেশ করে যেন দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছে এই সৈকতকে। স্বচ্ছ নীলাভ জল, ঢেউয়ের তীব্রতা কম থাকায় আমরা স্নানের লোভ সামলাতে পারলাম না। পর্যটকদের নব্বই ভাগই বিদেশী। তারা কেউ রৌদ্রস্নানে ব্যস্ত, কেউ আরব সাগরের নোনা জলের মজাতে মজে। নারকেলবীথির ধারে ধারে থাকবার জন্য মানানসই কটেজের সারি। সারা দিন নিজের মতো করে কাটাবার পরে বিকেলে দেখতে পেলাম এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বিকেলের রক্তিম সূর্য নীলজলে ডুবে গেল। এই দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে বার বার এখানে আসা যায়। আমরা ফিরে এলাম পানাজি। বাকী থাকল রাতের পালোলেম। সেটার মজা? আমি নাই বা বললাম। সবাই নিজে এসেই আবিস্কার করুক।
আরো জানার জন্যঃ GOA Tourism
| PALOLEM, GOA |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন