কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্য,Kaziranga National Park is famous for Indian one horned Rhinoceros
![]() |
| KAZIRANGA FOREST GATE |
সেই অর্থে “অরণ্য” দেখা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন, তাই মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা ছিলোই। প্রথমবার জঙ্গল সাফারি করবো, প্রকৃতির বুনো রূপের সৌন্দর্যে কখন মেতে উঠব তার জন্যই প্রহর গুনে চলেছি। প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্য পশুপাখিদের সাথে কেমন ভাবে, কোথায় , কতক্ষন ধরে দেখা হবে বা আদৌ গাছপালা ছাড়া আর কারো সাথেই মোলাকাত হবে না, এই নিয়ে মনের মধ্যে একটা দোলাচল চলছিল। তবে গৌহাটি থেকে এসে বিকেলবেলায় যখন কাজিরাঙ্গাতে পা রাখলাম, তখনই মনটা জুড়িয়ে গেল। নিঝুম, শান্ত, সবুজ অসাধারণ সুন্দর জায়গা। আমাদের রিসর্টের পাশ দিয়ে কালো মিশমিশে হাইওয়ে চলে গেছে। রাস্তার অন্যপ্রান্তে সবুজ গাছগাছালিতে ভর্তি, স্থানে স্থানে ঘন সবুজ চা বাগান এখানকার সৌন্দর্যকে আরো একধাপ বাড়িয়ে তুলেছে।
আমরা নিজের নিজের ঘরে মালপত্র রেখে বাইরে আসতেই আমাদের রিসর্টের ছাদে একটি সুন্দর হর্ণবিল পাখী এসে বসল, কিছুক্ষন পরেই তার জুড়িদার। মনে হলো আমাদের ওয়েলকাম করার জন্যই তারা এসে হাজির হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ক্যামেরাটা ব্যাগ থেকে বাইরে না এনে পারলাম না।
গৌহাটি থেকে আসার সময় হাইওয়ের বাঁদিকটা পুরোটাই অরণ্য। প্রবেশ পথগুলিও পরপর পড়ে। ওয়েষ্টার্ণ গেট, তারপর আমাদের রিসর্ট, তারপরেই কোহরা গেট। অনেকগুলি প্রবেশদ্বার আছে এই সুবিশাল অরণ্যের। কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান ৪৩০ বর্গকিমি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এখানে ২২০০ ভারতীয় একশৃঙ্গ গণ্ডারের বসবাস, যা সমগ্র পৃথিবীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। ১৯০৮ সালে মেরী কার্জনের আগ্রহে এই উদ্যান সংরক্ষিত হলেও ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা লাভ করে। তবে এখানে গণ্ডার ছাড়াও কিছু বাঘ, বাইসন, হাতি, হরিণ ও অগণিত পাখীদের বসবাস।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে গেল। আর কিছু করার না থাকায় কফি, পোকরা সহযোগে আড্ডা জমে উঠল। পরের দিন সকালে আমরা জিপ সাফারি করব। হাতি সাফারিটাও ভালোই হয় তবে এযাত্রায় স্থির হলো আমরা জীপেই যাব। হাতি সাফারিটা আরো ভোর বেলা শুরু হয়। এর সুবিধা হল , অনেকটা উপর থেকে বন্যপ্রাণীদের সহজেই নজর করা যায়। তাছাড়া হাতি মূল রাস্তা ছাড়িয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে বন্যপ্রাণীদের একদম কাছে চলে যেতে পারে, তাতে প্রকৃতির বুনো স্বাদটা যেন আরো ভালোভাবে অনুভব করা যায়। কিন্তু আমরা এক দেড় ঘণ্টাতে জঙ্গলের বেশ কিছুটা জায়গার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য জীপ সাফারিটাই বেছে নিলাম।
ভোরবেলাতেই উঠেছি, সঠিক
সময়ে বের হতে হবে। ভোর থেকেই ঘন কুয়াশা, রাস্তাঘাট সব সাদা। মন খারাপ হয়ে গেল, এত
দিনের পরিকল্পনা শেষে কি না কুয়াশার জন্য ভেস্তে যাবে ? আসাটাই মাটি হয়ে গেল !
যাইহোক কপাল ঠুকে আমরা রিসর্ট থেকেই জীপে চেপে বসলাম। কুয়াশা ভেদ করে জীপ ছুটল।
জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ, ভোরবেলায় খোলা জীপের ঠাণ্ডা বেশ উপভোগ্য। ওয়েষ্টার্ণ গেটে
পৌঁছাতেই দেখি আমাদের আগেই অনেক সাফারি
জীপ এসে হাজির হয়েছে। বেশ কিছু বিদেশী পর্যটক আছেন, প্রত্যেকের কাছেই
হাইজুম এস এল আর ক্যামেরা।
টিকিট, চেকিং,
ক্যামেরা ফি মিটিয়ে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করে গেলাম কাজিরাঙা ন্যাশানাল পার্কের
ওয়েষ্টার্ণ রেঞ্জে। বনের মধ্যে দিয়ে জীপ যাওয়ার মতো মেঠো রাস্তা। বড় গাছ কিছু চোখে
এল, তারপরেই সবুজ মাঠের মত কিছুটা জায়গা। সেই জায়গা পার হয়ে বাঁ দিকে এক সুন্দর
জলাশয়। আমাদের দেখেই এক ঝাঁক হর্ণবিল পাখি লম্বা ডানা মেলে দূরে মিলিয়ে গেল।
জলাশয়ের এতো কাছ দিয়ে গেল যে প্রকৃতির জলদর্পনে তার প্রতিচ্ছবি আমাদের মন ভরিয়ে
দিল। হঠাৎ করে পাওয়া প্রকৃতির এই
সৌন্দর্যে আমি এতটাই বিভোর হয়ে গেছিলাম যে
ক্যামেরা ব্যবহার করার কথা মাথাতেই আসে নি। আমাদের তিনটি জীপ পর পর চলছে। এখানকার
জীপগুলি চারজনের জন্য, মাথায় কোনো ছাউনি নেই, চারদিক লোহার বেষ্টনি দেওয়া। হঠাৎ
আমাদের সামনের জীপ দাঁড়িয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই পিছনের গাড়ীও থেমে গেল। পাতলা
কুয়াশার চাদর ভেদ করে আমাদের নজরে এলো সামনের গাছটির নীচেই একটি বড় গণ্ডার ঘাসের
ঝোপ ভেঙে এগিয়ে চলেছে। কোনো তাড়া নেই !! এই প্রথম চিড়িয়াখানার বাইরে প্রাকৃতিক
পরিবেশে গণ্ডার দেখা, মনটা আনন্দে ভরে গেল। ডান দিকে দূরে একটা গণ্ডার এত
ঠান্ডাতেও সকাল সকাল চান সেরে নিচ্ছে। আরো
এগিয়ে চলি। এবার পেলাম বড় বড় ঘাসের জঙ্গল, এগুলোকে বলে হাতি ঘাস। এখানকার অনেকটা
অঞ্চল হাতি ঘাসে ভর্তি। তারই মাঝে দেখা হলো এক হাতির পরিবারের সাথে। কিছু সময় পরে বাইসনের
একটা দল আমাদেরকে দেখতে দেখতে চলে গেল।
বুনো, মেঠো রাস্তা দিয়ে চলার যে একটা মাদকতা আছে , এটা প্রতিক্ষণে অনুভব করছি। কোনো কিছু দেখতে না পেলেও আমরা আশা নিয়ে চোখ ও ক্যামেরা এদিক ওদিক করছি। পাছে কোনো কিছু চোখ এড়িয়ে না যায়। শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম একটি ওয়াচ টাওয়ারের নীচে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম একেবারে উপড়ে। চোখ জুড়িয়ে গেল। এতক্ষণ যে দৃশ্য উপভোগ করছিলাম তার সাথে এর কোনো মিলই নেই। এ যেন অন্য কাজিরাঙা। সুবিশাল জলাশয়, দৃষ্টি চলে যায় জলাশয় ছাড়িয়ে আরো দূরে। চোখে আসে বক ও গণ্ডারের সখ্যতা। অবাক হয়ে দেখি চারদিকে গণ্ডার নিজের নিজের মতো নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে নজর কেড়ে নেয় পরিযায়ী পাখীদের দুষ্টিমি। দেখতে দেখতে সময় শেষ। অগত্যা ফেরার পালা। ফিরতে ফিরতেই পাকা পরিকল্পনা – পরের বার হাতি সাফারি, কোহরা গেট দিয়ে।
কী ভাবে যাবেনঃ গুয়াহাটীগামী যে কোনো ট্রেনে বা আকাশ পথে পৌঁছান যায় গুয়াহাটী। সেখান থেকে সড়ক পথে ২১৭ কিমি দূরে কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান। গুয়াহাটী যাবার ট্রেনগুলি হল- সরাইঘাট এক্সপ্রেস ( ১২৩৪৫ ), কামরূপ এক্সপ্রেস (১৫৯৫৯ ), গুয়াহাটী এক্সপ্রেস ( ১২৫০৯ , প্রতি শুক্র,শনি, রবি) ।
কখন যাবেনঃ নভেম্বর থেকে এপ্রিল এই সময়ের মধ্যে দেখে নিতে হবে।
কোথায় থাকবেনঃ অসম পর্যটনের অরণ্য ট্যুরিষ্ট লজ ( ০৩৭৭৬-২৬২৪২৯ ) ছাড়াও প্রাইভেট রিসর্ট বেশ কিছু আছে।



Very nice to read
উত্তরমুছুন