মান্ডু দুর্গ , Mandu Fort carries the history of Jahangir, Nurjahan, Bazbahadur, Rupmati
| JAHAJMAHAL , MANDU FORT |
বর্ষাকাল, প্রাসাদের বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি চলছে। ভিতরে সঙ্গীতপ্রিয় রাজা মজলিশে বসে প্রিয়তমা রাণীর পরিবেশন করা সঙ্গীতে বিভোর হয়ে আছেন অথবা সম্রাট তার প্রিয়তমা রাণীর হাত ধরে বসে বসে উপভোগ করছেন তালাও এর জলে প্রতিফলিত হাজার হাজার দীপশিখার অপরূপ দৃশ্য। না, এটা কোনো সিনেমা বা নাটকের দৃশ্য নয়। প্রায় ৪৬০ বছর পিছিয়ে গেলে সেইসময় মাণ্ডুতে এই দৃশ্য অতিপরিচিত ছিলো।
১৫৫৪ সালে বায়াজিদ খান মাণ্ডুর শাসন ক্ষমতা দখল করেন ও নাম পরিবর্তন করে পরিচিত হন বাজবাহাদুর নামে। সঙ্গীত ছিলো বাজবাহাদুরের প্রাণ। রাজকার্যের থেকেও সঙ্গীত বেশী প্রিয় ছিল তার কাছে
। মান সিং রাঠোরের কন্যা রূপমতি ছিলেন অসামান্য সুন্দরী ও সঙ্গীতজ্ঞা। হিন্দুকন্যা রূপমতির রূপে ও সঙ্গীতের টানে বাজবাহাদুর তার প্রতি অনুরক্ত হন। নিমার উপত্যকায় বয়ে চলা নর্মদা নদীর দর্শনের জন্য রূপমতি আসতেন। নর্মদা দর্শনের অঙ্গীকার পেয়ে রূপমতি বাজবাহাদুরের সাথে মাণ্ডুতে চলে আসতে রাজী হয়ে যান। পাহাড়ের ঢালে রেওয়াকুণ্ডের কাছেই ১৫০৮ সালে নাসিরুদ্দিন শাহের গড়া প্রাসাদ পরবর্তীকালে পরিচিত হয় বাজবাহাদুর প্রাসাদ হিসাবে। রূপমতি ও বাজবাহাদুরদের গানের মজলিশ বসত সেই প্রাসাদের সঙ্গীতমহলে । বাজবাহাদুর প্রাসাদ থেকে একটু এগিয়েই রূপমতি প্যাভিলিয়ন। অনেক দূর থেকে আফগান স্থাপত্যে গড়া এই প্যাভিলিয়ন দেখতে পাওয়া যায়। রূপমতি প্যাভিলিয়নের উপর থেকে মাণ্ডুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ।
| RUPMATI PAVILION, MANDU |
রূপমতির রূপে মুগ্ধ হয়ে মোঘল সম্রাট আকবর মাণ্ডু আক্রমণ করতে পাঠান তার সেনাপতি আদম খাঁ কে। বাজবাহাদুর পালিয়ে আত্মরক্ষা করলে মাণ্ডু মোঘলদের দখলে চলে আসে। সবশেষে কোন উপায় না দেখে নিজের সম্মান বাঁচাতে রূপমতি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
| RUPMATI PAVILION |
এই রকমই নানান ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে মাণ্ডুর আনাচে কানাচে। মধ্যপ্রদেশের বিন্ধ্যপর্বতমালার গায়ে প্রায় ৬৫০ মিটার উচ্চতায় মালোয়া মালভূমিতে অবস্থিত মাণ্ডু হলো এক ঐতিহাসিক দুর্গনগরী। লম্বায় প্রায় ৬ কিমি থেকে ৮ কিমি এবং চওড়ায় প্রায় ৫ কিমি থেকে ৬ কিমি বিস্তৃত এই শহর। পুরো পাহাড়ী শহরটিই দুর্গের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। ১২ টি প্রবেশদ্বার দিয়ে সাজানো এই দুর্গনগরীতে ৭৫টি ঐতিহাসিক সৌধ মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো। তবে একদিনে বা কারোর একক প্রচেষ্টায় এই সৌধগুলি তৈরী হয়নি। মাণ্ডুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন সময়ের শাসকরা একে নানান সৌধে সমৃদ্ধ করেছেন।
তবে অবশ্যই মাণ্ডুর আকর্ষণ শুধুমাত্র ঐতিহাসিক সৌধেই সীমাবদ্ধ নয়। মাণ্ডু হল প্রকৃতির স্নেহে লালিত ইতিহাস। এখানে প্রকৃতি ও ইতিহাস যেন একে অন্যকে জড়িয়ে রেখেছে। একটিকে বাদ দিলে অন্যটিকে ঠিক মতো অনুভব করা যাবে না। বিন্ধ্য পর্বত নিজের রূপের ঝাঁপি বছরভর সকলের কাছে মিলে ধরলেও সবুজ সৌন্দর্যের বিস্ফোরন হয় বর্ষাকালে। বৃষ্টিভেজা মাণ্ডুর যেন একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। একসময় মুঘল বাদশা আকবর ও জাহাঙ্গীরের বর্ষাযাপনের প্রিয় জায়গা ছিলো মাণ্ডু। এই সময় পাহাড়ী দুর্গ যেন প্রকৃতির নিজস্ব সাজে সেজে ওঠে। পাহাড়ের গায়ের গাছপালা সবুজ থেকে আরো সবুজ ও সতেজ হয়ে ওঠে। সবুজের রকমফের চোখের আরাম এনে দেয়। ভেসে থাকা মেঘের তলায় পর্বতের গা রকমারী সবু্জের চাদর দিয়ে যেন কেউ ঢেকে দিয়েছে বলে মনে হয়। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টিধোয়া ঐতিহাসিক সৌধগুলি আরো ঝকঝকে হয়ে ওঠে। মৃতপ্রায় ঝর্ণাগুলিও প্রাণ ফিরে পায়। তাদের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা জলের সুরেলা আওয়াজ যেন এখানকার অজানা ইতিহাসের কথা বলছে বলে অনুভূত হয়। বৃষ্টি ভেজা সবুজ প্রকৃতির পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষ্য থাকতে হলে বর্ষাকালে কদিনের অস্থায়ী ঠিকানা করতে পারেন মাণ্ডু। একটা পুরোদিনে মাণ্ডু ঘোরা হয়ে যায়। তবে শুধুমাত্র চোখের দেখা নয় মাণ্ডুকে জানতে হলে ও বেড়ানোর মজা নিতে হলে একরাত থাকতেই হবে এখানে।
বাজারের কাছেই রয়্যাল এনক্লেভ গ্রুপ, একদম দক্ষিনে রেওয়া গ্রুপ এবং এই দুইয়ের মাঝে সেন্ট্রাল বা ভিলেজ গ্রুপ। মোটামুটি তিনটি গ্রুপে বিভক্ত এখানকার দর্শনীয়স্থানগুলি। এছাড়াও আছে বাকী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু সৌধ।
আলমগীর, দিল্লী ও ভাঙ্গি দরওয়াজা পার হয়ে চলে আসুন মাণ্ডুর বাজার এলাকায়।এই জায়গায় ভিলেজ গ্রুপ বা সেন্ট্রাল গ্রুপের সৌধগুলি আছে। প্রথমেই দেখে নিন মামুদ শাহর তৈরী মার্বেল পাথরের আসরফি মহল। এরপর জামি মসজিদ। দামাস্কাসের Omayyed Mosque এর অনুকরণে বেলেপাথরের তৈরী এই মসজিদ আফগান শিল্পের নিদর্শন বহন করে চলেছে। তবে এর প্রবেশদ্বারের ডোমটাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন স্থাপত্য লক্ষ্য করা যায়। এই মসজিদের মাথায় ৫৮টি ছোট ও ৩টি বড় গম্বুজ শোভা পাচ্ছে। সকাল ৮-৩০ থেকে বিকেল ৫-০০ টার মধ্যে দর্শন করা যায় এই মসজিদ।
জামি মসজিদ দর্শন করে চলে আসুন হোসাং শাহের সমাধিস্থলে। শ্বেতপাথরের তৈরী এই সৌধ হিন্দু, মুসলিম ও আফগান শিল্পের মিশ্রণে নির্মিত। এখানে দরজার মধ্যে খোদিত এক লিপি থেকে জানা যায় যে - পাথরের জালির অসাধারন কাজ দেখে মুগ্ধ শাহজাহান তাজমহল গড়ার আগে ১৬৫৯ খ্রীঃ ওস্তাদ হামিদসহ চারজন স্থপতিকে এখানে পাঠান।
ভিলেজ গ্রুপের সৌধগুলি দর্শন করে সোজা চলে আসুন ৫ কি.মি. দূরের রেওয়াকুণ্ডের সৌধ দর্শন করবার জন্য। এখানে দেখবার মত জায়গা রেওয়াকুণ্ড, বাজবাহাদুর প্রাসাদ ও রূপমতি প্যাভিলিয়ন। এদের কথা আগেই বলেছি। রূপমতি প্যাভিলিয়নে প্রবেশ মূল্য লাগে ৫ টাকা।
তাছাড়াও কয়েকটি ছড়িয়ে থাকা সৌধের মধ্যে নীলকন্ঠ প্রাসাদের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। ১৬শতকে পাহাড়ী ঢালে লাল পাথরে তৈরী এই প্রাসাদ থেকে সামনের উপত্যকার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আকবরের দাক্ষিণাত্য বিজয় এখানকার দেওয়ালে লিপিবদ্ধ আছে। নীল গরল গলায় নেওয়া নীলকন্ঠ শিবের মন্দির এখানে প্রতিষ্ঠিত। তাই প্রাসাদের নাম নীলকন্ঠ প্রাসাদ।
| NILKAMTHA PALACE |
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই দেখে নিতে হবে রয়্যাল এনক্লেভ গ্রুপের সৌধগুলি। এই গ্রুপের সৌধগুলি হল দিলওয়ার খাঁ মসজিদ, হাতিপোল, নহর ঝরোকা, হিন্দোলা মহল, জাহাজমহল, তাভেলি মহল। এই সৌধগুলিতে পাঁচ টাকা প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি প্রবেশের অনুমতি মেলে। বিশাল এক ফটক অতিক্রম করতেই চোখ জুড়ানো দৃশ্য !! সামনেই বাঁদিকে সুবিশাল জাহাজ আকৃতির প্রাসাদ যা ‘শিপ প্যালেস’ বা জাহাজমহল নামে পরিচিত। জল না থাকলে জাহাজ মানাবে কেন ? তাই মহলের দুইদিকে দুই বিশাল কৃত্রিম জলাশয় বা তালাও। একদিকে মুঞ্জ তালাও ও অপরদিকে কাপুর তালাও। তালাও এর পাশে সুন্দর ফুলের বাগান। ডানদিকে তাভেলি মহল। ‘তাভেলা’ শব্দটির অর্থ ‘আস্তাবল’ হওয়ায় সহজেই অনুমান করা যায় এই জায়গা পূর্বে রাজা মহারাজাদের ঘোড়াদের থাকবার জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে অবশ্য এখানে খুব সুন্দর একটি মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে এবং তাভেলি মহলের উপরতলায় পর্যটকদের জন্য একটি রেষ্ট হাউস তৈরী করা হয়েছে। জাহাজমহল বাঁদিকে রেখে সোজা এগিয়ে বাঁদিকে বেলেপাথরের তৈরী ‘হিন্দোলা মহল’ বা ‘দোদুল্যমান প্রাসাদ’ (Swinging Palace)। আসলে এটি একটি ইংরাজী “T” আকৃতির বৃহৎ মিটিং হল বা দরবার। এখানে একটি প্রধান হল আছে (৩০মি.x১৮মি.x১২মি.), এর পার্শ্ব দেওয়ালগুলি ৩ মিটার চওড়া ও ৭৭ ডিগ্রী কোণে নত। যার জন্য মনে হয় যেন খানিকটা ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। হিন্দোলামহলের জাফরির কাজ সত্যি মুগ্ধ করার মতো। মহলগুলি দর্শনের সময় আজও শিহরণ জাগে।
হিন্দোলামহলের পাশেই নাহার ঝরোকা। মার্বেল দিয়ে নির্মিত। এই নহর ঝরোকা বা টাইগার ব্যালকনি থেকে সুলতান দর্শন দিতেন।
জাহাজমহলের নির্মাতা সুলতান ঘিয়াৎউদ্দিন মাণ্ডুতে রাজত্ব করেন ১৪৬৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫০০ খীষ্টাব্দ পর্যন্ত। কথিত আছে আমোদপ্রমোদ প্রিয় এই সুলতানের আমলে জাহাজমহলের হারেমে ১৫০০০ সুন্দরী থাকতেন।
৪০০ ফুট লম্বা, ৫০ ফুট চওড়া ও ৩২ ফুট উঁচু জাহাজমহলের নীচের তলায় তিনটি বিশাল হলঘর ও অনেকগুলি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের সাথে আছে একটি করে মন্ডপ। ঠিক যেমন আসল জাহাজে সিঁড়ি থাকে সেইরকমই প্রাসাদের বাইরে একটি সিঁড়ি দিয়ে জাহাজমহলের উপরে ওঠা যায়। । মহলের উপর থেকে পাহাড়ঘেরা মাণ্ডুর প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম। প্রাসাদের মিনার, গম্বুজ, মণ্ডপ, সেই সময়কার বিলাসবহুল স্নানাগার সবই দেখবার মতো। একতলায় কূর্মাকার ও দোতলাতে পদ্মাকার সুইমিং পুল আজও নজর কাড়ে সকলের।
১৫৬১ খ্রীঃ থেকে ১৭৩২ খ্রীঃ অবধি মাণ্ডু ছিল মোঘল শাসনের অধীনে। সেইসময় আকবর, জাহাঙ্গীর এখানে নানান স্থাপত্য নির্মান করান। প্রকৃতিপ্রেমিক সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে মাণ্ডুর প্রকৃতি ও এই জাহাজমহল এতটাই প্রিয় ছিল যে উনি পত্নী নূরজাহানকে সাথে নিয়ে দীর্ঘ ৭ মাস এখানে কাটান। জাহাজমহলের সৌন্দর্য, সেই সময়কার আমোদপ্রমোদের বর্ণনা, সম্রাট জাহাঙ্গীর তার অনুভূতি আত্মকথায় যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, তারপরে আর নতুন করে জাহাজমহলের কোন তারিফ করার প্রয়োজন হয় না।
কয়েক শতক ধরে বিভিন্ন রাজা, সুলতান , সম্রাটদের হাতে অতি যত্নে গড়ে ওঠা এই দুর্গের সৌন্দর্য ও ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেই আসুন না একবার মাণ্ডুতে।
কখন যাবেন
মাণ্ডু দেখার সেরা সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। আর বৃষ্টিভেজা মাণ্ডুর মজা নিতে হলে আসতে হবে জুলাই- আগষ্ট মাসে।
কোথায় থাকবেন
মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল- মালওয়া রিসর্ট, মালওয়া রিট্রিট। এছাড়া অন্যান্য হোটেলের মধ্যে হোটেল রুপমতি, মান্ডু-ইন ইত্যাদী। আরো বিশদে জানবার জন্য দেখতে পারেন মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের ওয়েবসাইট- www.mptourism.com
Osadharon bornona. Apnar lekha pore protibar notun kichu sikhi
উত্তরমুছুনKhub sundar lekha
উত্তরমুছুনDarn.Mandu r manas bhromon hoye gelo. Khub informative ar bhalo lekha.
উত্তরমুছুন