বীরভূমের অতীত রাজধানী , RAJNAGAR IS THE FORMER CAPITAL OF BIRBHUM DURING ISLAMIC RULE
| RUINS OF RAJNAGAR PALACE |
রাজনগর এসে অনুভব করলাম, আগে এখানে না এসে কি ভুল করেছি ! অনেক আগেই এই জায়গা দর্শন করা উচিত ছিলো। একদিকে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, অন্যদিকে এর অনন্য সাধারন স্থাপত্য – এই দুই আকর্ষণেই এখানে আসা যায়। পর্যটনস্থল হিসাবে এক কথাতে রাজনগরের পরিচয় হল – বীরভূমের অতীত রাজধানী। বীরভূমের বর্তমান রাজধানী তথা সদর শহর সিউড়ী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৫ কিমি।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে যতটুকু জানা যায় তা হলো –রাজনগরের প্রথমদিকে নাম ছিলো ‘ লক্ষ্মনোর’ । পরবর্তীকালে যা ‘ লক্ষ্মুর’ , ‘নাগর’ বা ‘নগর’ নামে পরিচিত হয়। দীর্ঘকাল ধরে রাজনগর শাসনকরেছেন প্রথমে হিন্দু রাজা ও পরবর্তীকালে মুসলমান রাজারা। হিন্দুরাজা বীর সিংহ ও চৈতন্য সিংহ যখন এখানে রাজধানী স্থাপন করেন তখন থেকেই রাজনগর বীরভূমের রাজধানী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে হিন্দুরাজাদের হাত থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে মুসলমানরাজের সূচনা হয় পাঠান বংশীয় আসাদুল্লা খাঁ ও জুনেদ খাঁ-র হাত ধরে। এরপরে রাজনগরে চলতে থাকে মুসলমান শাসন। জুনেদ খাঁর পঞ্চম পুরুষ বদিউজ্জামান খাঁ, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র কাছে রাজা উপাধি পান। তবে বেশীদিন তা স্থায়ী হয় নি। রাজা বদিউজ্জামানের পুত্র রাজা আসাদুজ্জামান খাঁ-ই হলেন বীরভূমের শেষ রাজা। তবে রাজপরিবারের উত্তরসূরীরা এখনো এখানে বসবাস করেন।
| Imambara Of Rajnagar |
রাজনগরের মাটিতে পা দিয়েই বুঝলাম জায়গা হিসাবে অতীতের রাজধানীর সেই গৌরব আজ আর নেই। গাড়ী থেকে নেমে আমরা মূলরাস্তা থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে একটি অপরিসর রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম। কিছুটা এগিয়ে হাজির হলাম ইমামবারার প্রবেশ পথে। এক বিশাল মাঠের একপাশে এটি অবস্থিত। অনেক দূর থেকেই সাদা রং-এর এই স্থাপত্য নজর কেড়ে নিল আমাদের। সিঁড়ি দিয়ে উপড়ে উঠে এলাম। চাক্ষুষ করলাম এই রাজকীয় এই স্থাপত্য। চওড়া দেওয়াল কত যে সুখ দুঃখ, উত্থান পতনের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে তা কে জানে!
| Inside view of Imambara Rajnagar |
| Kalidaha and in the middle of it Haoamahal |
ইমামবাড়ার পাশেই এক বিশাল জলাশয়, যার নাম কালীদহ। এর একদিক থেকে অন্যদিকে চোখ ঘোরাতেই নজরে আটকে গেল জলাশয়ের মাঝখানে দ্বীপের মতো এক জায়গাতে, বর্তমানে সবুজ লতাগুল্মে আবৃত। জানলাম সেটি হলো অতীতের হাওয়ামহল। বর্তমানে জীর্নদশা হলেও অবাক করে দেয় এখনো। উড়িষ্যার স্থাপত্যের অনুকরণে এই হাওয়ামহল নির্মান করা হয়েছিল।
| View of Kalidaha and Haoamahal from Imambara |
শোনা যায় যে এক সময় জলাশয়ের মাঝে এই স্থানে শক্তি-উপাসক হিন্দু রাজারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাথরের এক কালিকা বিগ্রহ। দেবীর নাম অনুসারে এই ‘দহ’ বা হ্রদ বা জলাশয়ের নাম হয় ‘কালীদহ’। পরবর্তী কালে মুসলিম শাসনকালে বহু টাকা খরচ করে এই জায়গায় গড়ে ওঠে হাওয়া-মহল।বর্তমানে ৮০০ বছরের প্রাচীন এই পাথরের কালীমূর্তি সিউড়ী থেকে ৯ কিমি দূরে বীরসিংহপুরের মন্দিরে আছে। কালীদহের দক্ষিনে রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ আজও শিহরন জাগায়। এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন গাব গাছটি। এখানেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল মাংলা মাঝিকে – একথা জানতেই গায়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল। এর অদূরেই ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দেখতে পেলাম ফাঁসিঘর ও বারুদঘর। সামনে দাঁড়ালে আজও টাইম মেশিনে চড়ে কয়েক শতক পিছনে চলে যাওয়া যায়।
| Barood Ghar |
| Gab Tree of Rajnagar |
রাজনগরের পথে পথে এগিয়ে চলি। এখানকার হাটে তরীতরকারী ছাড়াও চমৎকার দেখতে বাঁশের ঝুড়ি, কুলো বিক্রী হচ্ছে। ছোট অথচ জমজমাট বাজার। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ‘হামাম’-এ। এর গঠন আজও প্রায় অবিকৃত বললেই হয়। এটি রাজ পরিবারের বেগমদের স্নানাগার। সেই সময় কালীদহ থেকে জল বিশেষ কৌশলে পৌঁছে যেত ‘হামাম’এ। সেখানে জলকে স্নানের উপযোগী শীতল ও স্নিগ্ধ করে তোলা হোত। চওড়া দেওয়ালের ভিতর দিকে কিছু কারুকার্য ও চোখে পড়ার মতো।
| Inside view of Hamam or bathing place of Queens |
| View of Hamam |
এবার উল্টো দিকে পথ চলা। পৌঁছে গেলাম মোতিচূড় মসজিদে। ষোড়স শতকে তৈরী এই মসজিদ রাস্তার উপরেই। বর্তমানে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার’ দ্বারা সংরক্ষিত। এক সময়ে এই মসজিদের ছয়টি গম্বুজ ছিল। সামনের দিকে দুটি দেখবার মতো মিনার ছিলো। মোতিচূড় মসজিদের বিশেষত্ব হল এই মসজিদ টেরাকোটার সাজে সাজানো। টেরাকোটার কারুকার্যে সাজানো মন্দির কিছু দেখা গেলেও মসজিদ খুব একটা দেখা যায় না। সেদিক থেকে এটি একটি বিরল মসজিদ। এখানকার টেরাকোটা আয়তকার। বিষ্ণুপুর থেকে শিল্পীরা এসে এই টেরাকোটার সাজ ফুটিয়ে তোলেন। মসজিদের প্রবেশদ্বার পাঁচটি হলেও দুটি নকল দরওয়াজা।
| Motichur Mosque inside view |
| View of Motichur Mosque |
এখনো পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে রাজনগর
গড়ে ওঠেনি। তাই সংরক্ষনের অভাব থাকায় জায়গাটি অকৃত্রিম রয়ে গেছে। নিজের ইচ্ছা মত দেখে নেওয়া যায়। সাধারন মানুষের সাথে কথা
বললে বোঝা যায় এরা এখনো অতীত রাজধানীর গর্বেগর্বিত। দেখা করলাম বর্তমান রাজা মহম্মদ রফিকুল আলম খানের সঙ্গে। তার জনপ্রিয়তা ও তার প্রতি সাধারন মানুষের ভালোবাসা এতটাই বেশী যে, এখনো তাকে
প্রতি বছর রাজবেশে মহরমের শোভাযাত্রার সূচনা করতে হয়। চলার পথে কান পাতলে শোনা যায়,
এখানকার রাস্তাঘাট যেন ফিসফিসিয়ে বলছে রাজধানীর অতীত গৌরবের কথা।
রাজনগর দর্শন শেষে যখন চলে যাব ভাবছি, তখন গ্রামবাসীদের কাছে জানলাম কয়েক কিলোমিটার দূরে আছে এক সুন্দর আম বাগান। আমরা এসেছিলাম আমের সময়, জানলাম এখানে নিজের হাতে হিমসাগর, আম্রপালী আম,গাছ থেকে পেড়ে কিনবার ব্যবস্থা আছে। চললাম সেখানে। বীরভূমের এই দিকটায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। দূরে পাহাড়, চারদিক শুধুই সবুজ আর সবুজ। ঠিক যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি। পৌঁছালাম আম বাগানে। বিরাট বাগান , গাছগুলো ভীষন ছোট। আমরা বাগানে নিজের ইচ্ছামতো আম পাড়লাম। প্রকৃতির মাঝে সবাই আনন্দে দিশেহারা। কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে নিজের ইচ্ছামতো আম নিয়ে রাজার মতো রওনা দিলাম সিউড়ীর দিকে।একেই বোধহয় বলে রাজকীয় দর্শন !
| Mango Garden near Rajnagar |
হাতে সময় থাকলেঃ রাজনগর থেকে কয়েক কিমি দূরে তাঁতলোই এর উষ্ণপ্রসবন, একবার ঘুরে আসা যাতে পারে। এছাড়া সিউড়ি থেকে রাজনগর যাওয়া আসার পথে দেখে নেওয়া যায় সতীপীঠ বক্রেশ্বর, সেখানকার উষ্ণপ্রসবন। এছাড়াও পাথরচাপুড়িতে দেখে নেওয়া যায় দাতা বাবার মাজার।
প্রয়োজনীয় তথ্যঃ
কীভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে সিউড়ি আসার সরাসরি ট্রেন –(২২৩২১) হুল সুপার ফাষ্ট এক্সপ্রেস (ভায়া অন্ডাল) ; ৫৩০৪৫ ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ( ভায়া অন্ডাল)। এছাড়া ধর্মতলা থেকে সরাসরি সিউড়ী আসার সরকারী পরিবহনের বাস পাওয়া যাবে। সিউড়ী থেকে রাজনগরের বাস থাকলেও গাড়ী ভাড়া করে যাওয়াই ভালো।
কোথায় থাকবেনঃ সিউড়ীতে নানা মানের হোটেল ও লজ আছে। বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি আছে বীকোয়েস্ট ইন (ফোননম্বর ০৩৪৬২-২৫১০৭৭, ২৫১০৭৮,৯৭৩৪০৭৭০৭৭) , সারাদা লজ( ফোন নম্বর ০৩৪৬২-২৫১১৩৩), যুবরাজ লজ, হোটেল সাগর ( ফোন নম্বর ০৩৪৬২-২৫৮৭০০, ৯৪৩৪৩৯০২১০৯ ) ।
আমার ও চাকরি জীবন শুরু এই রাজনগরে ই । কিন্ত আজ যেন আরো নতুন করে অনেক তথ্য জানলাম। এককথায় অনবদ্য লেখা।👌
উত্তরমুছুন