ভাগ্য বড় না নিজের চেষ্টা বড় এই নিয়ে তর্ক হয়েই থাকে ............বাস্তব জীবনে নিজের অভিজ্ঞতা
অফিস ছুটির পরে বাস স্ট্যান্ডে আমাকে প্রেমাশীষদা বলল- “ অমিত , দত্তদাকে তিনটে চা , তিনটে ওমলেট বল। এখনো বাস আসতে দেরী আছে, সিউড়ি যখন পৌঁছবি তখন খিদে পেয়ে যাবে”। আমি কিছু বলার আগেই দত্তটা বলে উঠল- “ বসুন দাদা, আজ আপনাদের মালদাতেই যেতে হবে , তার আগে বাস নেই”। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের হাতে ওমলেট আর কাচের গ্লাসে চা চলে এলো। দত্তদার সাথে আমাদের সম্পর্ক এইরকমই ছিল।
সালটা ১৯৯৩-৯৪ হবে। নতুন চাকরী, বদলি হয়ে সবে রামপুরহাট অফিসে এসেছি। সিউড়ির বাড়ি থেকে যাতায়াত। যেতে সময় লাগত ঘন্টা খানেক। সিউড়ি রামপুরহাট রাস্তা তখন ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক হবার লক্ষে দিন রাত ভাঙা গড়ার খেলায় মেতেছে। তাই রাস্তার সামান্য ভাল , বেশীটাই খারাপ । কোথাও ঝাঁ চকচকে তো কোথাও কাঁচা মাটির রাস্তার অস্থায়ী বাইপাস। প্রাইভেট বাস বেশ কিছু থাকলেও সরকারী বাসের সংখ্যা হাতে গোনা। সেই সময় হাতে গোনা কয়েকটা নিত্যযাত্রী । আমি ,আমার দুই সহকর্মী পীযূষ ও প্রেমাশীষদা একসাথেই যাওয়া আসা করতাম। এছাড়া নিত্যযাত্রী হিসাবে সাথে পেয়েছিলাম সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের দুই দাদাকে। প্রতিদিন দেখতাম চোখের সামনে কেমন পালটে যাচ্ছে আমাদের চেনা ছবি। কোথাও বাড়ি ভাঙা পড়ছে, কোথাও দোকান। তার বদলে রাস্তায় লাগছে আধুনিকতার প্রলেপ। রাস্তা চওড়া করার নেশায় যেদিন গনপুরের সবুজ শাল, মহুয়ার জঙ্গল পাতলা হয়ে গেল সেদিন আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। শয়ে শয়ে গাছ শবদেহর মতো রাস্তার দুধারে পড়েছিল। তবুও আমরা আনন্দ পেলাম, জাতীয় সড়ক শেষ হয়ে গেলে আমাদের বাস নাকি ৯০ কিমি গতিবেগে যাবে। পুরো রাস্তা হয়ে গেলে সিউড়ি রামপুরহাট সময় লাগবে এক ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিটের পরিবর্তে মাত্রই এক ঘন্টা। সেই সময় যাতায়াতে কষ্ট ছিল বেশ। তবে রামপুরহাটে নেমে আমরা সব কষ্ট ভুলে যেতাম “দত্তদার দোকান”এ চা খেয়ে।
তখনও রামপুরহাট শহরের ভিতরের রাস্তা চওড়া করার কাজ শুরু হয় নি। তাই বাস স্ট্যান্ডের সামনের রাস্তাটা তখনও সরু থাকলেও ভাঙাচোড়া নেই। এই জায়গায় উচ্ছেদ, ঝামেলা, ভাঙাভাঙি শুরু হয় নি। এখানেই রাস্তার পাশে দত্তদার চায়ের দোকান। আমাদের চা খাওয়া কাম বিশ্রামাগার। মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা তিন দিক, তাতে দুটো জানলাও বসানো আছে। মাথায় খড়ের ছাউনি। আমাদের অসুবিধা না হলেও ব্যাঙ্কের সমীরদাকে মাথা নামিয়ে ঢুকতে হতো। দোকানের ভিতর দিকে একটা কাঠের তক্তা পাতা। এছাড়া ভিতর , বাইরে মিলে তিনটে কাঠের বেঞ্চ। এগুলোই ছিল আমাদের সময় পার করার জন্য বসার জায়গা। দোকানের সামনে ছিল মাটির উনুন । ঘুঁটে, কয়লার জ্বালানী দিয়ে সব সময়ই গনগনে আঁচ হয়ে থাকত। দোকানের খাবার লিস্টে ছিল কেক, দুধের সর দিয়ে পাউরুটি টোষ্ট, বাটার টোষ্ট, ডিম দিয়ে টোষ্ট, ডিমের ওমলেট, কলা, রকমারী বিস্কুট। চায়ের কথা আর নতুন করে কি বলব ? সেটাই ছিল দত্তদার দোকানের স্পেশাল, ঠিক যেমন খাবারে লবণের উপস্থিতির মতো। দত্তদারা দুই ভাই মিলে দোকান চালাতেন। তাদের সুন্দর ব্যবহারে একটা আকর্ষনীয় শক্তি ছিল, তাই বার বার আসতেই হতো। তাই সব সময় খদ্দেরের ভীড়ে দোকান গম্গম্ করত। সেই সময় দত্তদার চায়ের দোকান চেনে না এমন কোন মানুষ ছিল না। ভীড়ের চাপে ব্যস্ত থাকলেও মেজাজ ও ব্যবহারে তার কোন ছাপ পড়ত না।
অফিস থেকে ফেরার সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হত আমাদের। আমরা যে সরকারী বাসগুলোতে ফিরতাম সেগুলো কোনটা আসত শিলিগুড়ি থেকে, কোনটা আসত রায়গঞ্জ থেকে , কোনোটা আবার বালুরঘাট থেকে। দত্তদার মধুর ব্যবহারের জন্য সমস্ত দূরপাল্লা সরকারী বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ওনার দোকানের সামনেই বাস থামাতেন। সমস্ত যাত্রীরাও চা, টিফিন খেতে নামত । তাছাড়া সমস্ত নিত্যযাত্রীরা তো ছিলেনই। সব মিলিয়ে দত্তদার দোকানের একটা রমরমা ব্যাপার ছিল। সকলের সাথে তার একটা কাছের সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল। কখন কেউ ছুটিতে থাকলে দত্তদা খোঁজ নিত – “ অমিতদা , পীযূষদাকে কয়েকদিন দেখছি না ? ভাল আছে তো?” আবার দিনকয়েক ছুটির পরে অফিস জয়েন করলেও পাউরুটিতে বাটার লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন ভেসে আসতো – “ সমীরদা কদিন আসেন নাই, বেড়াতে গিয়েছিলেন নাকি?”
আমরা অফিস করে দোকানে আসা মাত্রই দত্তদা যত ব্যস্তই থাক না কেন “ আসুন পীযূষদা বা আসুন প্রেমাশীষদা” বলে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতেন। সারাদিনের সব খবর ওর কাছে থাকত। আমরা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই শুনতে পেতাম – “ গতকাল আপের শিলিগুড়ি ক্যান্সেল ছিল , তাই আজ ডাউনে ফিরবে না, পারলে বালুরঘাটে চেপে যান”। মানে বুঝতাম গতকাল সকালে সিউড়ি থেকে শিলিগুড়ি যাবার বাসটি যায় নি, তাই সেটির আজ বিকেলে ফেরার কথা কিন্তু থাকবে না। আমাদের অন্য বাসে যেতে হবে। তাছাড়া রাস্তার কোথায় জ্যাম, কোথাও দুর্ঘটনা ঘটে থাকলে সে খবরও আমাদের আগাম দিতেন। এই ভাবেই সব কিছু মিলে দত্তদার দোকান আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। শুধু খবর বা বিশ্রাম নেবার জায়গা নয় , সারা বছরের প্রখর গরম, প্রবল বৃষ্টি, ভয়ানক ঝড় সবকিছু থেকেই আমাদের মাথা বাঁচাবার একমাত্র জায়গা ছিল এই খড়ের চালার ছাতা।
এই ভাবেই দিব্যি চলে যাচ্ছিল দত্তদার সাথে আমাদেরও জীবন। দেখতে দেখতে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের বেশীর ভাগই তৈরী হয়ে গেল। সামান্য শহরের ভিতরের রাস্তা বাদ দিলে পুরো রাস্তা এখন কালো মিশমিশে, মাঝে সাদা রঙের চওড়া ডিভাইডার , দুপাশে হলুদ বর্ডার, তাতে লাল রিফ্লেক্টার। সেগুলো রাতে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ঝলমল করে। জীবনে প্রথমবার এই সব দেখলাম। বুঝলাম আমাদের গ্রাম , শহর বেশ উন্নত হল এবার। এবার চওড়া হবার পালা রামপুরহাট শহরের ভিতরে বাসস্ট্যান্ডের সামনের রাস্তা । শহুরে রাস্তা থেকে জাতীয় সড়ক হতে গিয়ে অনেক দোকান , বাড়ি , ঘরের পাশাপাশি দত্তদার দোকানও ভাঙা পড়ে গেল। আমাদের চোখের সামনে দোকানের জায়গাতে উন্নয়নের মিশকালো আস্তরন পড়ল। দত্তদার গোছানো দোকান রাতারাতি উঠে গেল ঠেলা গাড়িতে। সেখানে জায়গা কম , পছন্দের সব খাবারও অমিল। স্বাভাবিকভাবেই এই টালমাটাল অবস্থায় ভীড় কিছুটা কমে গেল। এরপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত অন্য আর একটা ঘটনা দত্তদার চায়ের দোকানের ইতি ঘটিয়ে দিল।
জাতীয় সড়ক হয়ে যেতেই এই রুটে প্রচুর সরকারী বাস চলাচল শুরু হল। যাত্রীরাও পছন্দ করতে লাগল দ্রুত গতির সরকারী বাসকে। যাত্রী তোলাকে কেন্দ্র করে ঝামেলা লাগল এক প্রাইভেট বাসের সাথে সরকারী বাসের । প্রাইভেট বাসের দাবী হল, সরকারী বাসের বাস স্ট্যান্ডে স্টপেজ দেওয়া চলবে না, তাহলে তাদের যাত্রী কমে যাবে। শেষ পর্যন্ত সেটাই মেনে নিতে হল সরকারী বাসকে। তাদের নতুন স্টপেজ হল রামপুরহাট বাস স্ট্যান্ডের আগে বগটুই মোড়ে ও বাস স্ট্যান্ড পার হয়ে লোটাস প্রেস মোড়ে। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে সমস্ত ড্রাইভার, কন্ডাক্টরদের সাথে যাত্রীরাও লোটাস প্রেসের স্টপেজে নামতে লাগলেন , সেখানেই টিফিন ও চা খাওয়া শুরু হল। রাতারাতি দত্তদার সমস্ত খদ্দের উধাও হয়ে লোটাস প্রেস স্টপেজের চায়ের দোকানে ভীড় জমিয়ে ফেলল। একদিনের মধ্যে কোন চেষ্টা, মেহনত ছাড়াই লোটাস প্রেসের চায়ের দোকানে ভীড় উপচে পড়তে লাগল।
যত দিন এগোতে লাগল দত্তদার সাথে
আমাদের দেখা হওয়া , ওনার কাছে চা খাওয়া
কমে আসতে লাগল। এখন আর দোকানে ভীড় হয় না
বললেই চলে। একদিন দত্তদা দুঃখ করে বলল – “ বলুন দাদা, আমি তো
রাতারাতি পথে বসে গেলাম”। শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল। এইভাবে পার হয়ে গেল আরো
কিছু সময়। এখন আর বাস স্ট্যান্ডে আসাই হয় না। আমরা সোজা নামি
লোটাস প্রেসের স্টপেজে। মিশকালো জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে নব্বই কিমি বেগে ছুটে
চলে আমার বাস। যাতায়াতের পথে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি জনসমুদ্রের ভীড়ে দত্তদার
দোকান কোথায় হারিয়ে গেছে। থেকে গেছে শুধু ৬০
নম্বর জাতীয় সড়ক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন