হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হল - বেড়ানোর বাইরে গিয়ে একটু অন্য গল্প
সিনেমা যাবি ? নিজেকে নিজেই বলে দেখলাম কানে কেমন খটকা লাগছে। এখন তো ‘সিনেমা হল’ হচ্ছে ‘আইনক্স’। সবাই দেখতে যায় ‘মুভি’। ভিন্ন ভিন্ন শো-তে ভিন্ন ভিন্ন মুভি। ভাবতে অবাক লাগে আগে এক একটা সুপার হিট ছবি এক একটা সিনেমা হলে চলত মাসের পর মাস। আমরা দল বেঁধে দেখতে গিয়েছি একই ছবি একাধিকবার। অথচ এখন ‘সিনেমা হল’ বলে কিছু নেই। ধীরে ধীরে সব শপিং মলে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন ওয়েবেও ছবি রিলিজ হয়। মূল কথা হচ্ছে বিনোদন। মানুষের বিনোদনের মাধ্যমটাই বদলে গেছে। আসলে আর পুরনো প্রথায় আনন্দ পায় না। কিন্তু আমরা ভুলতে পারি না সেই ‘সোনার দিন’গুলোকে। আজ স্মৃতির বই থেকে সময়ের চাদর সরিয়ে সেই সময়কার কয়েক পাতা তুলে আনছি সবার সামনে। আমার আজকের গল্প সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে নিয়ে।
আশির দশক , রমরমিয়ে চলছে চারপাশের সমস্ত সিনেমা হল । তখন মানুষের বিনোদন ছিল রেডিওতে নাটক, ছায়াছবির গান, অনুরোধের আসর, বিনাকা গীতমালা। একটু অবস্থাপন্ন মানুষদের ঘরে ছিল রেকর্ড প্লেয়ার। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ ছিল সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। একমাত্র মাধ্যম বললেও ভুল বলা হবেনা। সালটা ১৯৮৩-১৯৮৪ হবে। আমি তখন সবে মাধ্যমিক পাশ করে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছি। বন্ধুদের মধ্যেও একটা চোরা প্রতিযোগিতা চলত কে কটা লেটেস্ট সিনেমা দেখেছে। তারপর সে অন্যদের কাছে তার গল্প বলত, বাকীরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনত। আমরা মফস্বলের ছেলে, থাকতাম বীরভূমের সিউড়ীতে। আমাদের এই আধাগ্রাম আধাশহরে সাকুল্যে দুটো সিনেমা হল। বস্তাপচা সিনেমাগুলো চলত। কলকাতার সিনেমাহলে যে সব নতুন নতুন বাংলা, হিন্দি সিনেমা রিলিজ হত, সেগুলো আমাদের শহরের হলে আসতে আসতে আরো মাস ছয়েক বা মাস আটেক। কোনো কোনো সিনেমার ক্ষেত্রে বছরও ঘুরে যেত। তাই নতুন সিনেমা দেখে আসতে পারলে বন্ধুমহলে একটু বেশী আমল পাওয়া যেত বৈকি! আমার মামার বাড়ী ছিল কলকাতার বাগবাজারে। বছরে দুবার (পুজোর ছুটি ও গরমের ছুটি) আমাদের মামার বাড়ী যাওয়ার সুযোগ হত। মামার বাড়ী পৌঁছাবার সাথে সাথে মামাতো, মাসতুতো দাদাদের কাছে আব্দার করতাম সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। আমি আগে থেকেই খবরের কাগজ দেখে মোটামুটি মুখস্থ করে আসতাম হলের নামগুলো। না চিনলেও আমার ঠোঁটের ডগায় থাকত দর্পনা, উত্তরা, পূরবী, এলিট, উজ্জ্বলা, মিনার, বিজলি, ছবিঘর, রূপবানী, ইত্যাদী। অন্যদিকে মেট্রো, লাইটহাউস, গ্লোব, ইত্যাদীর খবর রাখলেও ইংরাজী সিনেমা দেখার অনুমতি ছিল না।
সেই সময় কলকাতার যে কোন সিনেমা হলে কারেন্ট টিকিট পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। ব্ল্যাক ছাড়া আমাদের টিকিট জোগাড় করার ক্ষমতাও ছিল না। আমি মামার বাড়িতে গেছিলাম কয়েকদিনের জন্য। সিনেমা দেখার প্ল্যান হতেই আমার মামাতো দাদা বলল- “টিকিটের জন্য গিরিলালকে বলব?” আমি বলি – “সে আবার কে?” দাদা বলে “ আরে আমাদের যে জমাদার রোজ ময়লা নিতে আসে ওর নাম গিরিলাল। জানিস তো কলকাতার পাঁচ সাতটা হলের টিকিট ব্ল্যাকারদের সাথে ওর দারুন ভাব। ওকে বললেই টিকিট জোগাড় করে দেবে”। আমি বললাম – “ তাহলে ওকেই বলে দাও”।
আমারা যথা সময়ে উত্তরা সিনেমা হলের সামনে গিরিলালের জন্য অপেক্ষা করছি। শোয়ের টাইম হব হব কিন্তু তার পাত্তা নেই, আমাদের টেনশন হচ্ছে। তাহলে কি আমরা বেমালুম মুরগী হলাম। ভাবতে ভবতেই দাদা বলে উঠল- “ ওই তো গিরিলাল, আমাদের খুঁজছে”। আমি তো চিনতেই পারিনি, সকালে যে চেহারাতে ওকে দেখি, এখন একদম আলাদা। পরনে চকচকে প্যান্ট, জমকালো সার্ট, কোমরে বেল্ট, গায়ে উগ্র পারফিউম, মুখে গোপাল জর্দা দেওয়া পান। গিরিলাল এসেই – “ চলুন চলুন” করে আমাদের হলের ভিতর নিয়ে গেল। দামী সিট। মিঠুন চক্রবর্তীর সিনেমা চলছে। হল অন্ধকার, হঠাৎ মিঠুনের একটা জমাটি ডায়লগের পরেই সবাইকে চমকে দিয়ে ‘ ইয়াআআ’ করে চিৎকার। আমরা অন্ধকারেও বুঝলাম গলাটা গিরিলালের। তারপরে ব্যাপারটা সয়ে গেল , প্রতিটি গরম ডায়লগেই ওই রকম তারিফ। আমি দাদাকে বললাম – “ আমাদের এবার হলের বাকী মানুষরা পেটাবে কিন্তু।” দাদা বলল “ চুপচাপ দেখে যা, কিছু ঝামেলা হলে বলব গিরিলালকে আমরা চিনি না।” সেদিন বাড়ি ফিরে আমাদের এটা নিয়ে কি হাসাহাসি। তারপর থেকে গিরিলাল অনেক বার সিনেমার টিকিটের অফার দিয়েছে কিন্তু আমরা সবিনয়ে প্রত্যাখান করেছি।
সেইসময় মিঠুন ছাড়াও জিতেন্দ্র, শ্রীদেবীর রমরমা বাজার চলছে। কারেন্ট শোওয়ের টিকিট পাওয়ার কোন সম্ভবনাই থাকত না। ব্ল্যাকে কেটে নেব এই মানসিকতা নিয়েই যেতাম। এইরকমই এক সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি আমার মামাতো দাদা গোগোদা, ও মাসতুতো দাদা অশোকদার সাথে দুপুরের শোওয়ে সিনেমা দেখতে গেলাম। সালটা ১৯৮৪ সম্ভবত। শো-এর টাইম জানিনা, সিনেমাহল অনু্যায়ী ১-৩০ বা ২-০০ এইসময় ম্যাটিনি শো শুরু হত। প্রথম হলে টিকিট পেলাম না, হাউসফুল বোর্ড লাগানো, ব্ল্যাকারদের হাতও ফাঁকা। দ্রুত পা চালালাম অপর হলের দিকে। পৌঁছলাম দর্পনাতে, কি সিনেমা চলছে তখনও জানিনা, জানবার সুযোগও হলনা। সিনেমাহল চত্বরে পা রাখামাত্র দুটো ব্ল্যাকার ব্যলকনির দামী সীট (তখন ৬-৫০টাকা) নামমাত্র বেশী দামে (১০ টাকাতে) আমাদের বিক্রি করে হাওয়া হয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল তাড়াতাড়ি ঢুকে যান সিনেমা শুরু হয়ে গেছে। আমরা তিনজন গেট্কিপারের কাছে টিকিট দেখাতেই আমাদের চরম অপমানিত হতে হল- “আপনারা শিক্ষিত লোক, সিনেমার শোওয়ের টাইমে আসেন না, ৩৫ মিনিট আগে শো শুরু হয়েছে।” এখনই ব্ল্যাকে টিকিট কিনেছি শুনে আরো খাপ্পা হয়ে গেল। যাইহোক হলে ঢুকে ঘন অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে চেয়ারের দিকে এগোতে লাগলাম মুখে না বললেও বহুলোকের নীরবে দেওয়া গালি খেতে খেতে চেয়ারে বসলাম। আমরা তিনজনেই জানিনা কি সিনেমা দেখছি। এটা তো আর পাশের লোককে জিজ্ঞেষ করার বিষয় নয়। যাইহোক আমি দেবশ্রী রায়, শ্রীদেবী ও জিতেন্দ্রকে চিনতে পারলাম। লজ্জাতে চুপচাপ কাঠ হয়ে বসে ছবি দেখে যাচ্ছি কিছুক্ষণ পরেই বিরতি হয়ে গেল। বাইরে একবার বেরিয়ে আমরা জানলাম সিনেমার নাম “জাষ্টিস চৌধুরী”। জিতেন্দ্র-শ্রীদেবী জুটির আরো একটা হিট সিনেমা। বিরতির পর একটু স্বাভাবিক হলাম। ভালভাবে আরাম করে বসতে গিয়ে দেখি আমার বসবার সিটটা চেয়ার থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভাবলাম যাঃ, সিটটা ভাঙা, ভাগ্যভালো পড়ে যাইনি। আমি আবার সিটটা ঠিক করে নিয়ে খাড়া হয়ে বসে থেকে বাকী সময় কাটিয়ে দিলাম।
সিনেমা দেখে মামার বাড়ীতে ফিরে এসে এই নিয়ে মজার আলোচনা। হঠাৎ অশোকদা বলল- “লাল্টু বল চেয়ারগুলোয় কেমন গদি ছিল, আর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল?” আমি অবাক হয়ে বললাম “তোমারটাও ভাঙা ছিল?” বাড়ীর আড্ডায় আর একপ্রস্থ হাসি। অশোকদা বলল- “বোকা, চেয়ারটা ভাঙা কেন হবে? দামী টিকিটের চেয়ারগুলো ওরকম সামনে এগিয়ে নিয়ে আরাম করে আধশোয়া অবস্থায় সিনেমা দেখা যায়।”
ফিরে এলাম নিজের বাড়ী সিউড়ীতে। স্যারের বাড়ীতে ইংরাজী পড়তে যেতাম। সেই টিউশন্ ব্যাচে গর্ব করে বললাম কলকাতায় “জাষ্টিস চৌধুরী” দেখে এলাম। গল্পটাও বললাম-চন্দন বলল - “তাহলে মামামিয়া পম্ পম্ গানটা কেমন দেখলি?” আমি বললাম “দারুণ!” কিন্তু কি করে বলি সেই গানের সিন্ আমাদের হলে ঢোকার আগেই হয়ে গেছিল। এটা কোনরকম মেক্আপ্ দিলেও পরেরটা অযাচিতভাবে মুস্কিলে পড়লাম। আমি বললাম – “দেবশ্রী রায় কে খুব কম ডায়ল্গ দিয়েছে। আসলে ওতো বাঙালী, হিন্দী ভালো বলতে পারবে না তাই জন্য মনে হয়।” স্যারের ছেলে আমাদের বন্ধু সুদীপ একটু খবর-টবর রাখতো সে বলল - “না, আমি জানি দেবশ্রী রায় একটা বোবার চরিত্রে অভিনয় করেছে।“ আমি বললাম - “হ্যাঁ সেই আর কি? বাঙালী বলেই ওকে বোবার রোল দিয়েছে যাতে হিন্দী বলতে না হয়। এই বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা দিলাম।” যুগ পাল্টেছে, ইউটিউবে সিনেমা রিলিজ হচ্ছে। তবে সিনেমাকে কেন্দ্র করে এতো উত্তেজনা ঘটনাবহুল অভিজ্ঞতা ও মজায় ভরা আড্ডা বোধহয় সেই সময় ছাড়া অন্য সময়ে পাওয়া যাবে না।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে পড়তে গেলাম মোহনপুরে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। হোষ্টেলে থাকতে হতো। পান্ডববর্জিত এই জায়গায় একমাত্র আনন্দ ও বিনোদন ছিল প্রতি শুক্রবারে “উর্বশী” হলে নাইট শো-তে সিনেমা দেখা। চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম কবে শুক্রবার আসবে তার জন্য। হোষ্টেল জীবনের একদম প্রথম দিকে আমি ও আমার রুমমেট্ চিরঞ্জীব চলেছি সিনেমা দেখতে। রাস্তায় একজন সিনিয়র আমাদের আটকাল- “কোথায় চলেছিস তোরা ?” আমরা বললাম– “সিনেমা”। দাদা প্রশ্ন করল- “কোন সিনেমা ?” আমার উত্তর - প্রসেনজিতের “দুটি পাতা”। দাদার সহাস্য উত্তর- “দেখো এখানে পড়তে এসেছ , দুটি পাতা দেখতে গিয়ে আবার জীবনের সব পাতা ঝরে না যায়”।
শোলে , একটি কালজয়ী সিনেমা। কোনদিন মনে হয় পুরনো হবে না। আমরা একদম ছোটতে দেখতে পাইনি, একটু বড় হয়েছি তখন থেকে এখনো পর্যন্ত বার ছয়েক দেখেছি। এখন দেখি শাহরুখ ভক্ত আমার ছেলেরও শোলে ভালো লাগছে। এই সিনেমাটার এটাই মহিমা। তবে পরের দিকে মানে ১৯৮০ এর পরের দিকের কথা বলছি – তখন সিনেমা হলে এমন কেউ থাকত না যে কিনা শোলে প্রথমবার দেখছে। মুশকিল হত কি কোনো একটা সিন্ পর্দাতে আসার আগেই সামনের সীটের, নয়তো পিছন থেকে কেউ আগাম বলতে শুরু করতো। রাগও হতো আবার মজাও লাগত। আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের বন্ধু অভিজিতকে পেলাম যে কিনা শোলে কোনোদিন দেখেনি। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে কল্যানী গেলাম শোলে দেখব বলে। অভিজিতকে দেখে আমার খুব হিংসা হচ্ছিল, কারণ আমাদের মধ্যে একমাত্র সেই প্রথমবার শোলে দেখার আনন্দটা পাবে। সিনেমা হলে পৌঁছে দেখি দারুন ভীড়। সিনেমা শেষ হওয়ার পরে আমরা একজায়গায় জড়ো হয়ে গেলাম, কিন্তু অভিজিতকে খুঁজে পাচ্ছি না। খানিকক্ষন পরে এসে বললো – “এক কান্ড হয়ে ছিলো, আমি তোদের কারোর হাত ভেবে একটা মেয়ের হাত ধরে নিয়ে ছিলাম।” আমরা তো অবাক ! বললাম – “তোকে কিছু বলেনি ?” অভি বললো – “মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো – ইয়ে হাত হাত নেহি, ফাঁসি কা ফান্দা।” আমাদের মধ্যে হাসির রব উঠে গেল। এগুলোই ছিলো, আশির দশকের সিনেমা দেখার মজা ও আনন্দ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন