হারিয়ে যাওয়া মেস জীবনের মজা ও আনন্দ

                            

                       চাকরী পাওয়ার পরে প্রথমবার মেসে থাকা। ছাত্রজীবনে হোষ্টেলে প্রায় পাঁচ বছর কাটালেও সেটার সাথে মেস জীবনের এতটা পার্থক্য আছে , সেটা আগে বুঝিনি। বর্তমানে সেই আদর্শ মেসের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। সময়ের সাথে পরিবর্তনের নিয়মে ধীরে ধীরে মেসের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে “পেয়িং গেষ্ট”। আমাদের বাংলা সিনেমার ইতিহাসে দেখা যায় , একটা সময় গেছে যখন “সাড়ে চুয়াত্তর” , “বসন্ত বিলাপ” এর মতো  বহু বাংলা সিনেমা মেস জীবনকে কেন্দ্র করেই তৈরী হয়েছিল।  

                          আসলে স্বাধীনতার সময় থেকেই রাজধানী কলকাতায় থাকবার প্রয়োজন বাড়তে থাকে সাধারন মানুষের। তখন সাধারন মানুষের হাতে পয়সা কড়িও খুব একটা ছিল না, সেই সঙ্গে কলকাতার বুকে থাকবার মতো অসংখ্য লজ, হোটেলও গড়ে ওঠেনি। তখন থাকবার একমাত্র ভরসা ছিল মেসরূপী বোর্ডিং হাউস। পুরনো কলকাতার বুকে বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য কলকাতায় ব্রিটিশ আমলে তৈরী হওয়া বাড়ীগুলোতেই গড়ে উঠল সস্তায় থাকা খাওয়ার জন্য বোর্ডিং হাউস। তখনকার কলকাতায় আমহার্ষ্ট স্ট্রীট, মুক্তারামবাবু স্ট্রীট, সীতারাম ঘোষ স্ট্রীট, কলুটোলা স্ট্রীট – এইসব জায়গায় রাস্তার গলিতে মেসবাড়ী ও বোর্ডিং হাউসগুলো দেখা যেত। মেস বাড়ীর নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট আছে, আছে এক নিজস্ব নিয়ম কানুন, সংস্কৃতি যা  মেস কালচার নামে বিখ্যাত। মেস জীবনের নানা মজাও ছিল। অবিবাহিত ছেলেদের মেসের পাশাপাশি মেয়েদের মেস থাকলে তার মজা যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা “বসন্ত বিলাপ” সিনেমাতে আমরা দেখেছি।

                              একটা সময় ছিল যখন বহু বড় বড় মানুষ বোর্ডিং হাউসে কাটিয়ে দিয়েছেন দিনের পর দিন। এদের মধ্যে নামী সাহিত্যিক, কবিও আছেন। শিবরাম চক্রবর্তী আজীবন মেসে কাটিয়েছেন, কবি জীবনানন্দ দাসও প্রথম দিকে বিধান সরনীর উপর একটি মেসে থাকতেন। ষাটের দশকের শেষের থেকেই পুরোনো কলকাতার গলিতে এই ধরনের আদর্শ মেসের সন্ধান মেলে। যার একটি কমন দরজা দিয়েই বহু পরিবারের যাতায়াত। দরজাতে প্রবেশ করেই একটা বড় সড় উঠোন , যা পথটুকু বাদ দিয়ে শেওলা দিয়ে মোড়া। একপাশে বড় চৌবাচ্চা, সেটা টাইম কলের জল দিয়ে ভর্তি হয়। স্নান করার জন্যও একটি বাথরুম। একটি ঘরে বসে মেসের ম্যানেজারবাবু নানান ব্যবস্থা করেন। কে কোন ঘরে থাকবে, কবে কি মেনু হবে ইত্যাদি।

                               এবার আসি নিজের কথায়। চাকরী জীবনের প্রথম পোষ্টিং বর্ধমান জেলার উখড়াতে। কম বয়সী প্রথম চাকুরেদের জন্য অত্যন্ত নীরস জায়গা। চারদিকে শুধু কয়লা খনি, পানীয় জলের অসুবিধা, লাঞ্চ ও ডিনার করার কোন ভাল দোকান নেই। এই রকম এক জায়গাতে থাকব কোথায় ? সবাই বলল এখানে একটি মেস আছে। দেখতে গেলাম, কল্পনার মেসের সাথে পুরোটা না হলেও অনেকটাই মিল পেলাম। তবে এখানকার সব বোর্ডার আমাদের অফিসের হওয়াতে একটু নিশ্চিন্ত হলাম। নতুন চাকরী পেয়ে এই প্রথম পড়াশোনার চাপবিহীন স্বাধীন জীবন। আমাদের এখানে রান্না করেন গোপালদা। টিভিহীন মেস, হাতেও তখন অ্যান্ড্রয়েড আসেনি, এই রকম অবস্থায় মেসে একমাত্র বিনোদন তাস খেলা। তাসের ফাঁকে ফাঁকে গোপালদার হাতে  তৈরী চা হেরো দলকে বাড়তি এনার্জি জোগাত। এই ভাবেই কাটছিল।  কিছু দিন চলার পরে আমাদের দুজনের শরীর খারাপ হয়ে গেল। আমরা কারণ খুঁজতে খুঁজতে রান্নাতে লাল গুঁড়ো লঙ্কাকেই কাঠগড়াতেই তুললাম। ঠিক হলো গোপালদাও চাইলেও আমরা আর কিনব না। সেই মতো চলছিল ভালই। হঠাৎ একদিন রাত্রে খেতে বসে আমরা অবাক। মাছের ঝোলে লাল লঙ্কাগুঁড়ো !! হ্যাঁ , তাই তো , এলো কোথা থেকে বোঝা যাচ্ছে না। পরের দিন গোপালদা কাজের আসতেই চারদিক থেকে প্রশ্নবাণ -  কি ব্যাপার, তুমি আবার লঙ্কাগুঁড়ো দিয়েছ ? পেলেই বা কোথা থেকে ? একটু পরিবেশ শান্ত হলে গোপালদা একগাল হেসে বলল – লঙ্কাগুঁড়ো ছাড়া কি রান্না হয় ? তাই আমার বাড়ী থেকে খানিকটা এনে রেখে ছিলাম। কাল খানিক বেশী হয়ে গেছিল, তাই তোমরা বুঝে গেলে। আমরা তো হাসব না রাগ করব বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে মেসবাড়ীর রান্না পরিবর্তন করা যাবে না এটা বুঝে গেলাম।

                    এতো গেল মেসের রান্নার কথা, এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। নতুন চাকরী পেয়ে বছর খানেক মেসে থাকার সুবাদে আমাদের অভিজ্ঞতা “মৌচাক” সিনেমার রঞ্জিত মল্লিকের থেকে কিছু কম হয় নি। উখড়া জায়গা ছোট, তাই বহু জনের নজরেই আমরা ছিলাম। শুধু মাত্র অভিভাবকেরাই নয় ,অনেক  কলেজ ছাত্রীও আমাদের চোখে চোখে রাখত। আমাদের যে খারাপ লাগত সে কথা বলব না। একদিন অফিসে আমাদের এক সহকর্মী দিদি বলল - হ্যাঁ রে  রমেশদা ( আমাদের অফিসের সিনিয়র সহকর্মী ) তোদেরকে ওনার বাড়ী যেতে বলে নি ? আমরা বললাম না তো। দিদি বলল – বলবে বলবে , কদিন যাকসত্যিই একদিন রমেশদা আমাদেরকে ডেকে বলল – তোমরা তো মেসে থাক আজ বিকেলে আমাদের বাড়ী এসো, ওখানেই জলখাবার খাবে। আমরা আগেই জেনেছিলাম রমেশদার তিন মেয়ে আছে। আমরা অফিস থেকে মেসে ফিরে যে যার মতো ভাল ড্রেস পরে চললাম রমেশদার বাড়ী। সেখানে রমেশদা যত রকম মিষ্টি উখড়াতে বিখ্যাত সব এনে হাজির করেছেন। বাড়ীর সকলের সাথে পরিচয় পর্ব মেটার পর এলো সবচেয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা। রমেশদা তিন মেয়েকে আমাদের পাঁচজনের সাথে গল্প করতে বসিয়ে একটু কাজে চলে গেলেন। সেই সময় আমরা এখনকার ছেলেদের মতো স্মার্ট ছিলাম না। বছর তেইস চব্বিশের আমরা পাঁচটি ছেলে চুপ করে বসে আছি, তিন কলেজ ছাত্রীর সামনে ।  তবে মেসে ফিরে আমরা সবাই একমত হলাম রমেশদার মিষ্টির মত তিন মেয়ের স্মার্টনেশও প্রশংসনীয়।

                 অবিবাহিত নতুন চাকুরে হওয়ার সুবাদে কোনো কোনো সময় অফিসের চেয়ারে বসেও বিয়ের কথা শুনতে হত। আমাদের অফিসের সাথে এক ডাক্তারবাবু কাজের সূত্রে জড়িত ছিলেন। উনি অফিসে এলে আমার কাছে একবার আসবেনই। কিছুদিন পরে বুঝলাম আমাকে ভালবাসার কারণ। একদিন উনি আমার কাছে আমার বাবার ঠিকানা চাইলেন, তার নাকি এক সুন্দরী ভাইঝি আছে। কয়েকদিন  ওনাকে ঘোরানোর পরে আমার মাথায় এক বদবুদ্ধি জাগল, আমি একদিন বললাম – আসলে আমার একজনকে ঠিক করা আছে। শুনে উনি বললেন – ও , তাই বলো, তুমি এনগ্যেজড   সেই থেকে আমারও মুক্তি। 

                           এর পর আমি বদলি হয়ে চলে এলাম রামপুরহাট। এখানে কাজ করার জন্য যেমন অন্য এক নতুন অফিস, থাকার জন্যও তেমনি  অন্য এক মেস। এখানে এসেও মেস জীবন পিছু ছাড়ল না। কাজেই মেসের মজা ও সেখানে থাকার সূত্রে ঘটতে থাকা  মজাদার ঘটনার সাক্ষী আমি এখানেও থেকে গেলাম।  প্রথম দিন মেসে এলাম। ঢুকতেই একটা হাতল দেয়া টিউব কল। জানলাম এখানকার জল খুব ভাল। এখানেও রান্না হয় ঘুঁটে কয়লার উনুনে। মেসের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দিনে বাজার করার দায়িত্ব ছিল ঠিক আগের মেসের মতোই। প্রথম দিন থেকেই বুঝলাম এখানেও বিনোদনের মূল উৎস তাস খেলা, সাথে গৌতমের টেপ রেকর্ডারে কুমার শানু , কিশোর কুমারের গান। এখানে আমরা মোট সাত জন , তার মধ্যে সুবীরদা একটু বড় ও একমাত্র বিবাহিত সদস্য। যদিও দেখে বোঝা যায় না। আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন বাসন্তীদি, এক্কেবারে নিজের দিদির মতো আমাদের স্নেহ করতেন। চাকুরে পাত্র খোঁজার ঘটনা এখানেও  ঘটতে থাকল। একদিন বাসন্তীদি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বলল –ভাই তোমরা বিয়ে করবে না ? আমি বললাম – তোমার কেউ চেনা  আছে ? উত্তরে দিদি বলল- আমি এই চিঁড়ে কলের দিকে যাই , দেখেছি ওখানে তিনজন দিদিমনি ( শিক্ষিকা ) মেস করে থাকে। ওরা আমার চেনা, কথা বলব ?

                              ব্যাচেলার মেম্বার নিয়ে মেস হবে কিন্তু প্রতিবেশীনিদের নজর থাকবে না , তাই আবার হয় নাকি ? এখানেও তাই ঘটনা ঘটল। এখানে আমাদের মেসের পার্থর বিয়ের ঠিক হল, সেটা বাইরের লোকেদের কাছে খবরও চলে গেল কিন্তু ঠিক কার বিয়ে সেটা কেউ বুঝতে পারে না। আমাদের সবার চেহারাই একটু “ছোট ছোট” ছিল। একমাত্র সুবীরদাকেই বিবাহযোগ্য মনে হত। আমরা বিকেলে অফিস ছুটির পরে একসাথে চার পাঁচজন ফিরতাম । ফেরার সময় আমাদের বাড়তি পাওনা ছিল একদল কলেজ পড়ুয়া মেয়ের বৈকালিক ভ্রমণ। তারা সেজে গুজে আমাদের ফেরার রাস্তাতেই ভ্রমণ সারত।

                                 একদিন ঘটল এক ভয়ানক ঘটনা। আমাদের সুবীরদা একা অফিস থেকে ফিরছিল। মেসে ঢুকেই সাংঘাতিক রাগে ফেটে পড়ল। কি ব্যাপার ? জানলাম – একা ফেরার সময় সুবীরদাকে ইঙ্গিত করে একটি মেয়ে  সানাই বাজাবার ভঙ্গিতে প্যাঁ প্যাঁ  আওয়াজ করে অপমান করেছে। শুনে আমরা হাসব না রাগব বুঝে উঠতে পারলাম না। পরে ব্যাপারটা পরিস্কার হলো  প্রতিবেশীনিরা বিয়ের খবর শুনেছিল কিন্তু কার বিয়ে বুঝতে না পেরে সুবীরদাকেই পাত্র ভেবেছে, আর এতেই যত গন্ডগোল।

                                   এই ভাবে সময় যেতে যেতে আমরা মেসবাড়ি ছেড়ে আলাদা আলাদা জায়গাতে থাকা শুরু করলাম। সবাই নিজের নিজের বাড়ীর কাছে বদলিও হয়ে গেলাম।  দেখতে দেখতে গড়িয়ে গেল বেশ কিছু বছর। এবার দরকার পড়ল কলকাতা শহরে থাকার। এলাম এখানে, খুঁজতে শুরু করলাম একটা ভাল মেস। না , পেলাম না । সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে পুরোন কলকাতা পরিবর্তিত হয়ে নতুন সাজে সেজে উঠেছে , সেটা যেন আজ আরো বেশী করে চোখে পড়ছে। কলকাতার পুরোন আমলের মেসবাড়ির সংখ্যা কমতে কমতে আজ প্রায় নেই বললেই হয়। দেখলাম সময়ের সাথে সাথে পুরোন বাড়ী যেমন বদলে গেছে ফ্ল্যাটবাড়ীতে ,ঝলমলে শপিং মলে, তেমনি  পুরোন মেসবাড়ি আর নেই তার জায়গা নিয়েছে আধুনিক ব্যবস্থা “পেয়িং গেস্ট”। এখন আমাদের হাতে সময় বড়ই কম, তাই শুধুমাত্র মূল্য দিয়ে আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ থাকতে হলে পেয়িং গেস্ট হচ্ছে সেরা অপশন সেখানে একই ছাতের তলায় থাকা মানুষদের জন্য সাজানো সব রকম আধুনিক ব্যবস্থা । তবে এখানে বড়ই অভাব মেস জীবনের মজা , আনন্দ ও  আন্তরিকতার।

                                        

                    

 

 

মন্তব্যসমূহ