নীল লেগুনের আকর্ষণে - Chilika Lake is the largest brackish water lake and It is considered to be the largest lagoon in India.


                        

CHILKA SEA MOUTH,  FOAM  OF WAVES
WAVES - CHILKA SEA MOUTH
  

                  সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে যত সমুদ্রই দেখি না কেন পুরীর মত এত প্রাণবন্ত সৈকত খুব কম আছে বলে মনে হয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে পুরী উড়িষ্যাতে হলেও আমাদের অনুভূতি এক্কেবারে দ্বিতীয় বাড়ির মত। আর জগন্নাথদেবের মন্দির দর্শন তো অন্য আর এক আকর্ষণ। আসলে বেশীরভাগ বাঙালীর বেড়ানোর হাতেখড়ি হয় পুরী ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে। এর পরেও পুরী বেড়ানোটা আরো আনন্দের হয়ে উঠতে পারে যদি একটা গোটা দিন রাখা হয় চিল্কা ভ্রমণের জন্য।

CHILKA LAKE , ODISSA, INDIA, SAND AND JHAU IN THE MIDDLE OF THE LAKE
জলের মাঝে বালির দ্বীপ

                          চিল্কা জায়গাটাই খুব মনোরম। যার একদিকে ঈষৎ লবণাক্ত, শান্ত জলরাশি; মাঝে ঝাউঘেরা সোনালী বালুতট , অপর দিকে অশান্ত সাগরের বিরামহীন ঢেউ সোনালী বেলাভূমিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। শীতের রোদে নীলজলরাশির উপর দিয়ে কয়েক ঘন্টার নৌকাবিহার যেন আগামী দিনের আনন্দের উৎস হয়ে থেকে যায়। প্রায় ১১০০ বর্গ কিমি ব্যাপী এক বৃহৎ উপহ্রদ বা লেগুন হল এই চিল্কা। জলের মধ্যেই দ্বীপ, টিলা,ঝাউবন। সব মিলিয়ে প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি এই জায়গা। একটি সরু জলপথ দিয়ে বঙ্গোপসাগরের নোনা জলের সাথে যোগাযোগ এই লেগুনের মিষ্টি জলের। এই লেগুনের জলের তিনদিকে উড়িষ্যার তিন জেলা-  পুরী, খুরদা ও গঞ্জাম। চিল্কার পর্যটন কেন্দ্রও তিনটি – সাতপারা, বরকুল ও রম্ভা। তবে পর্যটন কেন্দ্র তিনটি হলেও পুরী থেকে সাতপারা ভ্রমণের সুবিধাই বেশী। দূরত্ব মাত্রই ৫০ কিমি। বাসে বা গাড়ী ভাড়া করে দিনে দিনেই দেখে আসা যায় সুন্দর এই জায়গাটিকে। অন্য দুই জায়গা দর্শন গোপালপুরকে কেন্দ্র করেই করা হয়ে থাকে।  

                  আমাদের ঘোরাঘুরি পুরীকে কেন্দ্র করে। একদিন সকালে আমাদের গাড়ী ছুটলো চিল্কার দিকে। ঘন্টাখানেক যাবার পরে আমরা পৌঁছালাম সাতপারা। সেখান থেকে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা আছে। নৌকাবিহার করানোর জন্য দায়িত্ব নিয়েছেন- ডলফিন মোটর বোট অ্যাসোসিয়েশন। জলে ভেসে বেড়ানোর জন্য এদের কাছ থেকেই মোটরচালিত বোট রিজার্ভ করতে হয়। একটি নৌকাতে সর্বাধিক ছয়জনকে চাপার অনুমতি দেওয়া হয়।এরপর অতিরিক্ত প্রতি যাত্রীর জন্য ১০০ টাকা করে লাগে। আমরা একটি শক্তিশালী মোটর চালিত নৌকাতে ৮ জন চেপে বসলাম। ঘন্টা চারেক সময় লাগে পুরো জায়গাটি ঘুরে আসতে।  

 

CHILKA LAKE, SATPARA,ODISSA, INDIA, LARGEST LAGOON IN INDIA.
অসংখ্য নৌকো - নীল জলে ভেসে রয়েছে
 

            জলে ভেসে তীর থেকে দূরে সরে যাবার সময় একটু যে ভয় করছিল না, তা নয়। তবে কিছুটা যাবার পরে ভয়টা আনন্দে রূপান্তরিত হয়ে গেল। নৌকা যত এগোয় লেগুনের রূপ, রঙ যেন ততই খুলতে থাকে। কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম জলের মধ্যে অনেকটা জায়গা বাঁশ ও মশারীর জাল দিয়ে ঘেরা। জানলাম এইভাবেই এখানে চিংড়ির চাষ হয়।

            জলপথে আমাদের সাথে দেখা হল অসংখ্য জেলে নৌকা পর্যটকদের ফিরতি নৌকার সাথে। হঠাৎ আমাদের মাঝি ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ করে নৌকা জলে ভাসিয়ে রাখল। আমরা খানিকটা ভয়ে ও খনিকটা বিষ্ময়ে মাঝির মুখের দিকে তাকালাম। সে শুধু বলল – ‘সামনে দেখুন’। প্রথমটায় আমরা কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। কিন্তু একটু ভাল করে নজর করতেই চোখে পড়ল- একটা ডলফিন মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে আবার জলের তলায় চলে যাচ্ছে। ঠিক যেন আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। জানলাম এটাই নাকি ডলফিন পয়েন্ট।

 

GODDESS IN A TEMPLE, CHILKA LAKE, ODISSA, INDIA
মন্দিরে মূর্তি


          আর একটু এগোনোর পরে ভাটা পড়ে যাওয়া বালির চরে আমাদের নৌকা থামলো।প্রায় লাফিয়ে নামলাম বালির তটে। এখানে দর্শনীয় স্থান বলতে কয়েকটা মন্দির। তবে এই জায়গা থেকে চিল্কার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশ সুন্দর। সামনে বিশাল জলরাশি। সারি সারি রকমারি নৌকা চলছে তার বুক চিরে। মন্দির দর্শন শেষে ফিরে এলাম আমাদের জলযানে। আবার এগিয়ে চললাম।

CASUARINA ALONG THE COASTAL LINE , CHILKA LAKE
জলপথে যাবার সময় পাশে যা যা দেখেছিলাম
SAND HILL AND CASUARINA ALONG CHILKA LAKE, ODISSA

 

            দূরে দেখা যায় বালির পাহাড়, পুরোটাই ঝাউগাছে ঢাকা। যতই এগিয়ে চললাম ততই স্পষ্ট হয়ে উঠল সামনের বালির পাহাড়। অবশেষে পৌঁছালাম সী-মাউথ। ডানদিকে বালির পাহাড়ের গায়ে ঝাউবনের নজরকারা সৌন্দর্য। কেউ লম্বা, কেউ বালিতে শুয়ে আয়েস করছে, কেউ বা হেলে গিয়ে জল ছুঁতে চায়। আমরা কোন অচেনা দ্বীপে নামার ভঙ্গীতে হাঁটু জলে নেমে পড়লাম। তীরের কাছে জল বেশ স্বচ্ছ, সেই স্বচ্ছ জলের তলায় প্রচুর ঝিনুকের দেহাবশেষ পড়ে থাকতে দেখলাম।

 

SAND ISLAND IN CHILKA LAKE, ODISSA, INDIA, TOURIST SPOT
                                                        আমরা নৌকা থেকে এখানেই নেমেছিলাম  

              জল থেকে বালিতে হাঁটতেই বালিতে সারি সারি দিয়ে গাছের পাতায় ছাওয়া কিছু দোকান। জানলাম এগুলো নাকি খাবারের দোকান। অর্ডার মতো ( প্রায় জোড় করেই ) ভাত,ডাল, মাছ রান্না করে দেবে। আমাদের আকৃষ্ট করার জন্য ( পরে বুঝেছিলাম ঠকাবার জন্য ) কয়েকটা পাত্রে জীবন্ত কাঁকড়া, পার্শে, চিংড়ি রাখা আছে। যাইহোক আমরা ভাত, ডাল ও চিংড়ির অর্ডার দিয়ে চলে গেলাম ঘুরতে। লেগুনের দিক থেকে আমরা বালির উপর দিয়ে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে লাগলাম। বালির উপর এক ধরনের লতাগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ বালিকে আঁকড়ে ধরে চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে সোনালী বালিতে কেউ সবুজ আলপনা দিয়ে রেখেছে।

 

GREEN DESIGN IN THE SAND OF CHILKA LAKE, ODISSA, TOURIST SPOT
সোনালী বালিতে  সবুজ আলপনা
 

          আরো কিছুদূর এগিয়ে বালির এক প্রাচীর অতিক্রম করতেই চোখের সামনে এলো এক অপূর্ব দৃশ্য। নীল সমুদ্র , পরিচ্ছন্ন সৈকত, তার মধ্যে অগণিত ঢেউ আছড়ে পড়ছে। আর তার থেকে তৈরী হওয়া দুধ সাদা ফেনা দিয়ে ঢেকে যাচ্ছে চারদিক।এখানে আরো যেটা মজার তা হল ঢেউ এর সাথে কাঁকড়া আসছে। আবার ফিরতি টানে সমুদ্রে হারিয়েও যাচ্ছে সেই কাঁকড়া।বাচ্চাদের সাথে বড়রাও কাঁকড়াদের সাথে লুকোচুরি খেলাইয় মেতে উঠল। এইভাবেই সময় কোথা দিয়ে পার করে ফেললাম বুঝতেও পারলাম না।       

 

CRAB IN THE SEA MOUTH, CHILKA LAKE,ODISSA, INDIA, TOURIST SPOT
এই কাঁকড়াদের নিয়েই অনেকখানি সময় কেটেছিল
 


         
চরম খিদে নিয়ে ফিরে এলাম লাঞ্চ সারতে।খেতে বসে বুঝলাম ভালোই ঠকেছি আমরা। ঘুরতে যাবার সময় যেসব জীবন্ত চিংড়ি সাজানো ছিল ঘুরে এসে দেখলাম তারা বহাল তবিয়তেই আছে। আমরা ভাতের সাথে পেলাম ছোট ছোট চিংড়ির ঝোল তাও টাটকা বলে মনে হল না।খিদের মুখে তাই ভাল !! খাবার পরে হাত মুখ ধোবার জায়গা দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করতেই লেগুনের জলের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল।

 

CHILKA LAKE, ARRANGEMENT FOR LUNCH IN THIS SMALL SHOP.
পাতা ছাওয়া দোকানগুলি আমাদের লাঞ্চ খাইয়েছিল
 

           এবার ফেরার পালা।  নৌকা ভটভট শব্দে এগোতে লাগলো। ধীরে ধীরে ছোট হতে লাগলো পাতার ছাউনি দেওয়া দোকান, বালির পাহাড়, ঝাউবন। পড়ন্ত দুপুরে তখন লেগুনের জলে রূপালি আলোর ছটা ঝিকমিক করছে।ফিরে এলাম সাতপাড়া। গাড়ি ছুটলো পুরীর পথে।স্মৃতির বইয়ে যুক্ত হলো আরো একটি আনন্দের পাতা।

  


           কীভাবে যাবেনঃ পুরী থেকে গাড়ি ভাড়া করে বা কন্ডাক্টেড ট্যুরের বাসে করে দর্শন করা যায়। পুরী থেকে সাতপারার দূরত্ব মাত্র ৫০ কিমি।    

            রাত্রিবাস করতে চাইলেঃ রাত্রিবাস করতে চাইলে উড়িষ্যা ট্যুরিজমের সাতপারা পান্থনিবাসে ( ফোন – ০৬৭৫২- ২৬২০৭৭ ) থাকতে পারেন। ভাড়া ৫৫০ টাকা থেকে ২১০০ টাকার মধ্যে।

 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন