জলপ্রপাত ও মার্বেল রকের ম্যাজিক শো ( Spectacular view of Narmada falls, marble rock and boating in river Narmada )
মার্বেল পাথরে মোড়া অট্টালিকা দেখেছি, মন্দির দেখেছি কিন্তু তাই বলে একটা আস্ত নদী মার্বেল পাথরে মোড়া!! হ্যাঁ, নিজের চোখে সেটা দেখব বলেই তো ছুটে আসা মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে। যখন থেকে জব্বলপুরের নাম শুনেছি, তবে থেকেই জব্বলপুর, নর্মদার মার্বেল রক ও ধূঁয়াধার জলপ্রপাত সমার্থক হয়ে আছে মনের মধ্যে।
ডিসেম্বরের শীতের সকাল। তাকে উপেক্ষা করেই সকাল সকাল টিফিন করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শহর দর্শনে। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে দেখতে জব্বলপুর থেকে ২৩ কিমি দূরের নর্মদার মার্বেল রক জলপ্রপাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। গাড়ি থেকে যেখানে নামলাম সেখান থেকে নদী বেশ খানিকটা দূরে। যতই এগিয়ে চলি ততই মার্বেলের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। শুরু হল দুইপাশে মার্বেল পাথরের তৈরী নানান লোভনীয় সৌখিন দ্রব্য। মার্বেল পাথরের ফুলদানী, ধূপদানী, গনেশ মূর্তি, নন্দী মূর্তি কি নেই সেখানে ! দুপাশে সৌখিন দ্রব্যের দোকানের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি। পথ কিন্তু সমতল নয়, কোথাও উঁচু, কোথাও ঢালু, কোথাও সিঁড়ি নেমে গেছে।
| Narmada Water Falls, Jabalpur |
এভাবে যেতে যেতে একসময় চোখের সামনে এলো সুবিশাল জলরাশি, দুদিক মার্বেল পাথরে মোড়া। দূর থেকে বয়ে আসা এই বিশাল জলরাশি প্রবাহের হঠাৎ পথ শেষ , অগত্যা ১২০ ফুট উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর এতেই সৃষ্টি করছে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। জল পড়বার সময় তৈরী হচ্ছে দুধসাদা ফেনার মত জলরাশি, সাথে কোটি কোটি সূক্ষ্ম জলকনা। আমরা এক্কেবারে কাছে চলে গেলাম। সেখানে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। আর এগোবার জায়গা নেই। বাতাসে ভেসে বেড়ানো সূক্ষ্ম জলরাশির দাপটে আমাদের মুখমন্ডল, ক্যামেরার লেন্স ভিজে যেতে লাগল। শুধু আমরা নই জলকনার জালে সূর্যের সাতরঙা রামধনুও আটকে থেকে আমাদের আনন্দ বাড়িয়ে দিল। চোখ যত দূরে যায় দেখি অশান্ত নর্মদা ধীরে ধীরে শান্ত রূপ নিয়ে মার্বেল পাথরে তৈরী একাধিক পথ দিয়ে এগিয়ে চলে যাচ্ছে।
তবে এই অপার্থিব সৌন্দর্যের স্বাদ অসম্পূর্ণ থেকে যেত যদি কেবল্ কারে না চাপতাম। কাউন্টারে টিকিট কেটে চেপে বসলাম। যাতায়াত মিলিয়ে ভাড়া। কেবল্ কারে যতই এগিয়ে চলি ততই সৌন্দর্য যেন বেড়েই চলে। এ যেন অন্য এক জগত ! নীচে থাকা অবস্থায় দেখা দৃশ্যপটের সাথে কোন মিল নেই। খরস্রোতা নর্মদা মার্বেল রকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। উপর থেকে দুধসাদা ফেনার মত নর্মদার সৌন্দর্যই আলাদা। এরপর সেই জলরাশি ভাগ হয়ে একাধিক পথে ছুটে চলেছে। সেই পথের দুইধারের দেওয়াল নানান আকার, আকৃতির, রঙ বেরঙের মার্বেল দিয়ে তৈরী। প্রকৃতির কি অপূর্ব সৃষ্টি !
| View from Cable Car, Narmada River |
আমরা নামলাম নর্মদার অন্য দিকে। এখানে ভীড় অনেকটাই কম। দেখা মিলল শিকারী পাখিদের , যারা খরস্রোতা নদীর বুক থেকে অনায়াসে মাছ শিকার করে চলেছে। সূর্যের অবস্থান দেখে বোঝা যাচ্ছে সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে। সূর্যের ছটায় ভেসে থাকা জলরাশিতে রামধনু তৈরী হচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির নিজের লেসার শো দেখছি। এবার ফিরতে হবে। এবার যাব পঞ্চবটী ঘাট, যা ভেরাঘাট নামেই পরিচিত। সেখানেই হবে নৌকা বিহার।
| Beauty of Marble Rock from Narmada River |
জলপ্রপাত দেখে প্রায় দুই কিমি দূরে এসে পৌঁছালাম। এটাই ভেরাঘাট। অনেকটা সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলাম। সারি সারি নৌকা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে নর্মদা একেবারে শান্ত। আমরা ভেসে পড়লাম জলে। নৌকার মাঝিরাই পর্যটকদের গাইড। তারা বেশ ছড়া কাটার কায়দাতে আমাদের বর্ণনা দিয়ে যেতে লাগল। খানিকটা এগিয়ে যেতেই দেখি দুদিকে মার্বেল পাথরের দেওয়াল। অতি নরম এই মার্বেল পাথর জলের স্রোতে ক্ষয়ে গিয়ে নানান রূপ ধারন করেছে। তাদের রঙের বাহারও দেখবার মত। কোনটা দুধ সাদা, কোনটা নীলাভ, কোনটা সবুজাভ। চূনাপাথর, গ্রানাইট, আগ্নেয়শিলার বিভিন্ন রঙ এই পাহাড়গুলিকে মনোরম করে তুলেছে।
| Beauty of Marble Rock from Narmada River |
বিদায়ী সূর্যের নরম আলোয় মার্বেলের দেওয়াল নানা রঙে সেজে উঠল। এবার ফেরার পালা। সূর্য বিদায় নেওয়ায় জলে থাকা অবস্থাতেই সন্ধ্যে নেমে গেল। নিঝুম জলপথ, ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া আর নৌকার ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ হঠাৎ মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করল। সবাই চুপ। দূরে দেখি সারি সারি আগুনের শিখা। আরো একটু এগিয়ে আমাদের নৌকা জলে ভেসে থাকল। আমরা সাক্ষী থাকলাম আরো এক মনোরম দৃশ্যের। ভেরাঘাটে নর্মদা মায়ের আরতি চলছে, আমরা সেটা দর্শন করছি নর্মদার জলে ভাসমান থেকে। এ যেন উপরি পাওনা। আমি বললাম – আবার আসব এখানে। আমার বন্ধু বলল – পরের বার দেখব পূর্ণিমার রাতে। তাকিয়ে রইলাম নর্মদার জলে তৈরী হওয়া আরতির প্রতিবিম্বের দিকে। স্বপ্ন সত্যি হবে তো ?
থাকবার জায়গাঃ M.P. Tourism Hotel
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন