কালী পুজোর রাতে মল্লিকপুরে

                  

 

MA KALI MALLICKPUR, BIRBHUM
মা কালী, মল্লিকপুর গ্রাম, বীরভূম

বীরভূমে যে কয়টি বড় বড় পারিবারিক কালীপুজো হয় তাদের  মধ্যে  ইন্দ্রগাছা ও মল্লিকপুরের কালীপুজো দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।  দীর্ঘ লক্‌ ডাউন,  সামাজিক দূরত্ব , মুখে মুখোস , বার বার হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার নিয়ে থাকতে থাকতে আজ খুব বেশী করে মনে পড়ছে  বছরখানেক আগে  মল্লিকপুরে  দেখা  কালীপুজোর রাতের কথা। বন্ধুর বাড়ির পুজো হওয়াতে  মাকালী  তৈরী করার সময় থেকেই  দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এখন কালীপুজোর  আর হাতে গোনা  কয়েকদিন   বাকী।  সিউড়ি থেকে মাত্রই কয়েক কিমি দূরের এই গ্রামে গিয়ে  কালী পুজোর প্রস্তুতি থেকে শুরু করে পুজো অবধি স্বাদ  নিয়ে আসতেই পারেন। দূর দেশে গিয়ে কালীপুজো দেখার থেকে এখানে আনন্দ এতটুকুও কম হবে না একথা হলফ করে বলতে পারি। আজকে আমার  সেই অভিজ্ঞতার  কথাই  এখানে  জানাব।  

 

PUJA MANDAP OF  MALLICKPUR , BIRBHUM
মা কালীর মন্দির

                   লালমাটির জেলা বীরভূমের এই  মল্লিকপুর গ্রাম যেন আদর্শ গ্রামের বাস্তব রূপ। প্রায় তিন দিক নদী দিয়ে ঘেরা এই গ্রাম।  প্রাচীন এক বটবৃক্ষ প্রায়  দেড়শো বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে নদীর ধারে আজও দাঁড়িয়ে থেকে  সবাইকে স্বাগত জানিয়ে চলেছে।  এই প্রাচীন গাছের পাশেই  প্রায় ৩৫০ বছরের প্রাচীন কালীপুজো  এই গ্রামের সিংহ পরিবারের। যতদূর তথ্য পারিবারিক সূত্রে পাওয়া যায় , তাতে জানা যায়  শ্রদ্ধেয় সাধক কালীচরণ সিংহ  এই পুজো শুরু করেন। বর্তমানে বনেদী এই  পরিবারের পুজোর  নামডাক বীরভূম ছাড়িয়েও পাশের জেলাগুলিতেও পৌঁছে গেছে। দুর্গা , লক্ষ্মী -নারায়ণ, শিবের মন্দিরে  নিত্য পুজো হয়।  পরিবারে  দুর্গাপুজোও হয়। তবুও সব কিছুকে ছাপিয়ে  এক রাতের এই কালীপুজোকে ঘিরেই যত ধূম। এখন এই পুজো পারিবারিক হলেও  গ্রামের সব মানুষ এই পুজোকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠেন।  কালীপুজোর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র  সিংহ পরিবারেই ফ্যামিলি গেট টুগেদার হয় না, গ্রামের প্রতিটা বাড়িতেই  গেষ্ট আসেন। 

                        নদীর ধারে প্রাচীন বট বৃক্ষের পাশে  তিন দিক খোলা মাকালীর মন্দির । অনেকটা রঙ্গমঞ্চের মত।  জানা যায়  তিন দিক খোলা রাখার কারণ সবাই যাতে একসাথে মাকে দর্শন করতে পারেন। শ্বেতপাথরে বাঁধানো এই মন্দিরে উঠতে গেলে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভাঙতে হয়। মন্দির ও প্রাচীন বটবৃক্ষের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মাকালীর মূর্তি।  মায়ের যা রূপ এক কথায় বলা চলে ভয়ঙ্কর সুন্দর। আর পাঁচটা সাধারন কালীমূর্তির থেকে  এই মূর্তি  কিছুটা আলাদা। মা এখানে  "ঝলক রাণী"  নামে পরিচিতা। তবে  সুবিশাল এই কালী মূর্তি কিন্তু এই মন্দিরে তৈরী করা হয় না।  এটি তৈরী হয় মন্দির থেকে কিছুটা দূরে একটি জায়গায়। সেখান থেকে মাকে মন্ডপে নিয়ে আসাটাই দেখবার মত। জনা কুড়ি পঁচিশ বলিষ্ঠ মানুষ কাঁধে করে মাকে মন্ডপে নিয়ে আসেন।  

 

MAKING OF  GODDESS KALI, MALLICKPUR, BIRBHUM
প্রতিমা তৈরীর কাজ চলছে



                   আমি গিয়েছিলাম তখন প্রতিমা তৈরীর কাজ চলছিল। শিল্পী তখন বাঁশের মাচায় চেপে মায়ের মুখের আদল ঠিক করছেন। এরপর আমি আবার যাই কালীপুজোর দিনে। প্রথা মেনে মাঝ রাত ছাড়া মায়ের পুজো হয় না। তার আগে চলে তুমুল ব্যস্ততা। মাকালীকে রঙ করা শুরু করেন পরিবারের সদস্যরা। গায়ের রঙ থেকে মায়ের মাথার চুল সব কিছুই প্রস্তুত করা হয় নির্দিষ্ট পারিবারিক প্রথা মেনে। শেষ কাজ  সোনার অলংকার দিয়ে মাকে সাজানো। একদিকে যখন মাকালীকে সাজাবার কাজ চলছে, তখন বাইরে মন্দির প্রাঙ্গনে এসে দেখি গ্রাম্য মেলা বেশ জমে উঠেছে। চুলের ফিতে, নখপালিশ থেকে ঘুঘনি, পাঁপড়ভাজা কি নেই সেখানে। অন্যদিকে স্টেজ সাজাবার কাজ চলছে। মাঝরাতে যাত্রা হবে যে ! তারজন্যও অনেকে সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। 

MA KALI  AT THE TIME OF  PUJA, MALLICKPUR
কালী পুজোর দিন, মন্দিরে মা

 
ঢাকের তালে.........

               এরপর যত রাত হয়, ততই মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ি। একদিকে জমজমাট মেলা। সারা জায়গা মানুষের ভীড়ে থিক থিক করছে। হঠাৎ একটু বেশী ব্যস্ততা। সকলেই  মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে ব্যস্ত। সত্যিই ক্যামেরা বন্দী করার মতো দৃশ্য।  বিশাল মা কালীর প্রতিমাকে  মন্দিরে আনা হচ্ছে। মনে হচ্ছে জনসমুদ্রে মা ভেসে আসছেন। এই পর্ব শেষ হবার পরে পুজোর আয়োজন। পুজো, বাজনা, নাচ, আড্ডা, যাত্রা , মেলা সব মিলিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। দেখতে দেখতে রাতটুকুও  শেষ হয়ে এলো। কখন যে পুব আকাশ আলোয় ভরে গেল বুঝতেই পারলাম না। এগিয়ে গেলাম নদীর দিকে, নদীর জলে পুবের লাল আভা, বিদায়ী কাশফুলের মলিন  প্রতিচ্ছবি। দূর থেকে কানে এলো ঢাকিদের দ্রিমি দ্রিমি বোল। 

 মা কালীকে মন্ডপে নিয়ে যাওয়ার ছবি দেখার জন্য নীচে ক্লিক করুন ঃ 


 
 কীভাবে যাবেনঃ  বীরভূমের সদর সিউড়ি থেকে মাত্রই ৬ কিমি। অটো, প্রাইভেট কার এমন কি রিক্সাতেও যাওয়া যেতে পারে।
 

 

 

মন্তব্যসমূহ