গোলকুন্ডা দুর্গ, Golkonda Fort of Hyderabad is the early capital of the Qutb Shahi dynasty

        

GOLKONDA  FORT OF  HYDERABAD, EARLY CAPITAL  OF the Qutb Shahi dynasty,
Golkonda Fort

                             প্রাচীন ইতিহাসে সমৃদ্ধ বড় বড় শহরগুলো আজকের দিনে যতই আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে ফেলুক নিজেদের, হেরিটেজ সিটির নিদর্শন হিসাবে আজও কিন্তু প্রাচীন স্থাপত্যগুলি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তা সে দিল্লী, লক্ষ্মৌ, হায়দ্রাবাদ যে জায়গাই হোক না কেন, এই সত্যটা সবার ক্ষেত্রেই খাটে। এদের যেন একটা আলাদা আকর্ষনী আছে, দেখতে দেখতে মনে হয়  যেন টাইম মেশিনে করে সেই সময়ে আমাদের পৌছে দিলো। কাজের জন্য হাইটেক সিটি হায়দ্রাবাদে এলেও, এই আকর্ষনী শক্তির জোড়েই চারমিনার, মক্কা মসজিদ, সালার জং মিউজিয়াম ও গোলকুন্ডা দুর্গ দেখার লোভ সামলাতে পারিনি।

                    কোন প্যাকেজ ট্যুরে নয়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে আটোতে ভ্রমণ। চারমিনারের উপরে উঠে গাইডের মুখ থেকে হায়দ্রাবাদের ইতিহাস শুনছি। জানলাম এখান থেকে আবছাভাবে দৃশ্যমান হয়ে থাকা গোলকুন্ডা দুর্গের সাথে চারমিনারের সুরঙ্গ পথে যোগাযোগ ছিলো। যদিও আজকের দিনে তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। হায়দ্রাবাদে রাজধানী নেমে আসার আগে অবধি  গোলকুন্ডা দুর্গ থেকেই রাজকার্য চালানো হত। ইতিহাস জানতে জানতে দুর্গ দেখার আগ্রহ বেড়ে গেল। হাতে পুরো একটা দিন সময় রাখলাম দুর্গ দেখার জন্য। মনে হলো যে গোলকুন্ডা দুর্গ থেকে নেমে এসে হায়দ্রাবাদের পত্তন সেই দুর্গ একবার নিজের চোখে না দেখলে এবং ভালভাবে না জানলে বো্ধহয় হায়দ্রাবাদ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। 

                   পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পড়লাম। একটি অটো করে চললাম গোলকুন্ডা দুর্গ। পথ প্রায় ১১ কিমি।মূল জায়গা্তে পৌঁছাবার অনেক অনেক আগে থেকেই রাজকীয় এই স্থাপত্য নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। দ্বাদশ শতকে ওয়ারংগলের কাকতীয় বংশের রাজা গণপতি মাটি দিয়ে একটি দুর্গ নির্মান করান। এটিই গোলকুন্ডার প্রথম দুর্গ। এরপর কাকতীয়দের হাত থেকে বাহমনি সুলতানদের ( ১৩৪৬ থেকে ১৫১৮ খ্রীঃ ) হাতে যায় এই দুর্গ। বাহমনি সুলতানদের আমলে এই দুর্গ গ্রানাইট পাথর দ্বারা নির্মিত হয়। বাহমনি সুলতানদের তেলেঙ্গানার সুবেদার ছিলেন কুলী কুতুব উল মুল্ক। তিনি পারস্য থেকে ঘোড়া বিক্রী করার জন্য এদেশে আসেন। কিন্তু বাহমনিদের দূর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ১৫১৮ খ্রীঃ কুতুবশাহী রাজের ( ১৫১৮ থেকে ১৬৮৭ খ্রীঃ) স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। তিনি রাজধানী গড়ে তোলেন গোলকুন্ডায়।এরপর ৫ম সুলতান মহম্মদ কুলী কুতুব শাহ ১৫৯০ খ্রীঃ গোলকুন্ডা থেকে নেমে এসে হায়দ্রাবাদ শহরের পত্তন করেন।প্রথম দিকে তার প্রিয়া ভাগমতীর নাম অনুসারে শহরের নাম হয় ‘ভাগ্যনগর’পরে হিন্দু মেয়ে ভাগমতী বেগম হয়ে পরিচিত হন হায়দরমহল নামে। তখন শহরের নামও পরিবর্তিত হয় ভাগ্যনগর থেকে হায়দরাবাদে।

Golkonda fort of Hyderabad,  Place of  Diamond KohinoorGolkonda  Fort, Hyderabad
Golkonda Fort


                    দুর্গে পৌঁছানোর অনেক আগেই অতিক্রম করে গেলাম এক বিশাল ফটক।তার নীচ দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে।দুর্গের চারদিক প্রাচীর ঘেরা। এরপর আরো খানিকটা এগোনোর পর মূল গেটে পৌঁছালাম। বিশাল প্রাচীর বেষ্টিত প্রধান গেট। আমরা টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ঢুকেই চোখের সামনে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গেলো। গোটা একটা পাহাড়ের গা জুড়ে কর্মকাণ্ড। রাজধানীকে নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।  

                 গোলকুন্ডা দুর্গের পরিধি ১১ কিমি। ১৫ মিটার  থেকে ১৮ মিটার উঁচু প্রাচীর দিয়ে পরিবেষ্টিত।গ্রানাইট পাথরের তৈরী ৮টি প্রবেশদ্বার ছিল; যার মধ্যে একটার মধ্য দিয়ে আমরা এখানে এলাম।দুর্গের মধ্যে ঢুকেই আমরা প্রথমে থামলাম ‘ফতে দরওয়াজা’তে। এখানে হাততালি দিলে সেই শব্দ পাহাড়ের উপরে অবস্থিত ‘দরবার হল’ থেকে শোনা যায়।এই রকমই ছিল সেই আমলে সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যবস্থা। কোন জরুরী বার্তা রাজার কাছে পাঠাবার জন্য এই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হতো।দরওয়াজা ছাড়িয়ে এগোতেই প্রাচীন এই দুর্গের বিস্তার চোখের সামনে চলে এলো। পর্যটকদের সুবিধার জন্য কোন স্থান থেকে যাত্রা শুরু হবে, কোথায় কি দেখতে পাওয়া যাবে এবং কোনদিক দিয়ে যাত্রা শেষ হবে তার একটা সুন্দর নির্দেশিকা এখানে বোর্ডে দেওয়া আছে। আমাদের বাঁদিকে অস্ত্রাগার ও ডানদিকে নাগিনা বাগ। মাঝখানে পাথরের উঁচু সিঁড়ি ও বাধানো পথ ঘুরে ফিরে দরবার হলের দিকে চলে গেছে।আমরা পাথুরে সিড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম। পথে কোন কোন জায়গায় একপাশে, কোথাও দুইপাশেই উঁচু দেওয়াল। আমরা নাগিনা বাগকে ডানদিকে রেখে চলতে শুরু করলাম। কিছুটা পথ এগোই, মাঝে মাঝে বিশ্রাম। কখনো ক্যামেরায় চোখ রাখি, কখনো নিজের চোখে দেখে ইতিহাসকে রয়ে বসে অনুভব করি। এইভাবে এগোতে এগোতেই একে একে দেখে নিলাম আক্কন্না মাদন্না ( দুই মন্ত্রীর দ্বিতল কার্যালয় ), রামদাস জেল, কুতুবশাহী মসজিদ, যেটা সুলতান ইব্রাহিম কুতুবশাহ নির্মান করেন।এরপর দেখলাম বরাদরি- এটি এক দোতলা স্থাপত্য যার উপর তলা ব্যবহার করা হতো শহরের দৃশ্য দেখার জন্য।আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে একদিক দিয়ে উঠে আবার অন্য দিক দিয়ে নেমে এলাম।পাহাড়ের এক্কেবারে উপরে রয়েছে ১২ টি খিলানযুক্ত ত্রিতল দরবার হল।এছাড়াও হারেম মহলসহ নানান মহল। দুর্গের একেবারে উপর থেকে পুরো হায়দ্রাবাদ শহরের একটা সুন্দর দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুর্গের চারপাশে পরিবেষ্টিত প্রাচীর ও দরওয়াজা উপর থেকে পরিস্কার দেখতে পাওয়া যায় নামবার সময় আমরা দেখে নিলাম সিলাখানা ও তারামতি মসজিদ। ভগ্নপ্রায় হলেও গোলকুন্ডা দুর্গের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি।আজও সামনে থেকে দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। তখনকার দিনে শীততাপ নিয়ন্ত্রনের জন্য যেভাবে জল সরাবরাহের ব্যবস্থা ছিলো তা দেখে বিষ্মিত হলাম।মাটির নল ও পার্সিয়ান চাকার সাহায্যে জল তুলে প্রাসাদ ঠাণ্ডা রাখা হতো। দেখতে দেখতে সূর্য আস্তাচলে। সন্ধ্যের পর এখানকার মূল আকর্ষন ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ এর প্রদর্শনী। প্রথম শো টাই ইংরাজীতে হয়, সময় মার্চ থেকে অক্টোবর সন্ধ্যে ৭ টায় এবং বছরের বাকী সময় ৬-৩০ থেকে। দিনের শেষে বিষ্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই আমরা আবার আটো্তে।

 

Golkonda  Fort, Hyderabad

কখন যাবেনঃ নভেম্বর থেকে মার্চ ঘোরাঘুরির জন্য আদর্শ সময়। গোলকুন্ডা দুর্গ দেখার সময় শুক্রবার বাদে সব দিন সকাল ৯-৩০ থেকে বিকেল ৫-০০ ।

 কীভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে সরাসরি হায়দ্রাবাদ আসার ট্রেন ১৮৬৪৫ ইস্টকোস্ট এক্সপ্রেস। ১১-৪৫ এ হাওড়া ছেড়ে  পরের দিন ১৮-৩০ এ হায়দ্রাবাদ পৌঁছায়। অপর ট্রেন ১২৭০৩ ফলকনামা এক্সপ্রেস ৭-২৫ এ হাওড়া ছেড়ে পরের দিন সকাল ৯-৩৫ এ সেকেন্দ্রাবাদ পৌঁছায়।

 কোথায় থাকবেনঃ হায়দ্রাবাদ রেল স্টেশনের কাছে  হোটেল গোপী ( ডবল বেড ৯০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা ); তাছাড়া হোটেল রাজমাতা (ডবল বেড ৮০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা); এছাড়া তেলেঙ্গানা ট্যুরিজমের হরিথা তারামতি বারাদরি রিসর্ট ( ডবল বেড এসি ২০০০ টাকা )

শপিং: দুর্গের কাছে নানান ক্র্যফট এর কাজ ও অন্যান্য গিফট আইটেম পাওয়া যায়। 

 

 

মন্তব্যসমূহ