শীতেই চলুন অমরকন্টকে ( AMARKANTAK popularly known as "Teerthraj" - "the king of pilgrimages")
| নর্মদা নদী, অমরকন্টক |
বিন্ধ্য ও সাতপুরা পাহাড়ের সংযোগস্থলে ১০৬৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত অমরকন্টক যুগ যুগ ধরে সাধনাক্ষেত্র হিসাবে সমাদর পেয়ে আসছে। পবিত্র নদী নর্মদা ও শোনের উৎসস্থল হচ্ছে এই অমরকন্টক। প্রকৃতিদেবীর আশীর্বাদধন্য চারদিকে পাহাড়ঘেরা এই জায়গা পবিত্র সরোবর, নদী, ঘন জঙ্গল, দৃষ্টিনন্দন জলপ্রপাত, গা ছমছমে গুহা ও প্রাচীন মন্দিরে সমৃদ্ধ। আসলে অমরকন্টক প্রকৃতি, ইতিহাস ও ধর্মের এক অদ্ভুত সংমিশ্রন।
এই জায়গা প্রকৃতিপ্রেমিকদের কাছে যতটা আকর্ষণীয় ততটাই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে হিন্দু তীর্থস্থান হিসাবে। অমরকন্টকের স্থান মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য, মহাকবি কালিদাসের কাব্যে ও বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। শোনা যায় ভগবান শিবের বরে নর্মদা হয়েছিলেন সর্বপাপহর। কোনো ভক্ত যদি নিজেকে শাপমুক্ত করতে চান তবে তাকে পবিত্র গঙ্গানদীতে একবার ডুব দিতে হবে, যমুনার তীরে সাতদিন ও সরস্বতীর তীরে তিনদিন প্রার্থনা করলেই হবে। কিন্তু নর্মদার স্থান অনন্য। একবার ভক্তিভরে নর্মদা দর্শন কোন ভক্তকে পরিশুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ঠ। বহু মহামান্য মুনি ঋষিদের সাধনাক্ষেত্র হলো এই অমরকন্টক। মনোরম প্রাকৃতিক শোভা ও আধ্যাত্মিকতার টানে যুগ যুগ ধরে মানুষ ছুটে আসছেন এই দেবভূমিতে।
পেনড্রা রোড, অমরকণ্টকের নিকটতম রেলস্টেশন – দুরত্ব মাত্র ৪৩ কিমি। ছোট্ট স্টেশন, বাইরে বেরিয়ে আসতেই বুঝলাম জায়গাটাও খুব বড়ো নয়। এখান থেকেই অমরকণ্টক যাবার নানান ব্যবস্থা রয়েছে। মালপত্র গাড়ির মাথায় চাপিয়ে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল পাহাড়ী পথে। অমরকণ্টকের নানা ভ্রমণকাহিনী আগে পড়ে আনন্দ পেলেও ভ্রমণকালে নিজের চোখে দেখা ও নিজের অনুভূতির যে আনন্দ, তা এমনই যে কোন কিছুর সাথে তার তুলনা করা যায় না।
| অমরকন্টক যেতে সবুজে ঘেরা পথ |
গাড়িতে চলার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা পাহাড়ী পথের সৌন্দর্যে ডুবে গেলাম। কিছু কিছু জায়গায় পথ অসমান হলেও পরের দিকে রাস্তা সত্যিই সুন্দর। দুই পাশে সবুজ বন, মাঝে কালো ফিতের মতো মসৃণ রাস্তা। পথ চলতে চলতে এমন এক জায়গায় এলাম, যেখানে আমরা গাড়ি থেকে না নেমে পারলাম না। জায়গাটা থেকে রাস্তা দুইদিকে বহুদূর দেখা যাচ্ছে। এক্কেবারে ফাঁকা, কোন জনমানব বা যানবাহন নেই।
| আলো ছায়ার খেলা, অমরকন্টকের পথে |
পথের
দুইধারে সবুজ বন, সেখানে কোন কোন জায়গায় পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যের ছটা ঘন বনের
মধ্যে ফাঁক-ফোকর খুঁজে নিয়ে লেসার রশ্মির মতো মাটি স্পর্শ করেছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য
! সবাই আমরা সেই দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করার চেষ্টা করছি। এরপর আমাদের গাড়ি যখন
হোটেলের সামনে পৌঁছাল, তখন সন্ধ্যে হব হব।
আমাদের সামনে পাহাড়, পিছনে নর্মদা নদী ও অনেকটা সবুজ সমতল, যার উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। সূর্যের আলো চলে যেতেই অনুভব করলাম এখানকার শীতের কামড় বেশ তীব্র। অন্য পর্যটন কেন্দ্রের মত এখানে হোটেল বা লজ বেশী নেই। মন্দির, ধর্মশালা বা আশ্রমে থাকার ব্যবস্থাই বেশি। তাই অন্য স্থানের মত হোটেলের আরাম বা বিলাসিতা এখানে আশা না করাই ভাল। এছাড়াও এখানে নিরামিষ আহার করাই রীতি।
| নর্মদা মন্দির |
পরের দিন খুব ভোরে আমরা কয়েকজন বাইরে ঘুরতে বের হলাম। কনকনে ঠান্ডা, পথঘাট একদমই ফাঁকা। দুই একটা চায়ের দোকানে সবে উনুনে আগুন দিতে শুরু করছে। চা পেতে অনেক সময় লাগবে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা নর্মদার উৎসস্থলের কাছে চলে এলাম। একটু আলো ফোটার পর স্থানীয় এক মাঝবয়সী মহিলা আমাদেরকে পাশের দোকানের টিনের চালাতে হাত দিয়ে দেখতে বললেন। আমি হাত দিয়েই বিদ্যুতের শক খাবার মত হাত সরিয়ে নিলাম। আমার সঙ্গীরা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি বললাম – বরফের মত ঠান্ডা ! পরে ভাল করে হাত দিতে বুঝলাম সত্যিই বরফের আস্তরন ! তবে পাতলা ফিল্মের মত । চায়ের দোকানের মহিলার কাছে জানলাম যে এখানে রাত্রে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে চলে যায়। তখন জমে থাকা শিশিরও ছাড় পায় না, তাকেও বরফ হয়ে যেতে হয়।
| নর্মদা মন্দির |
আজকের দিনটাতে আমাদের পরিকল্পনা করে বেড়ানোর কোন ব্যাপার নেই। আমরা নিজেদের মত করে এই দেবভূমিকে উপভোগ করব। চান সেরে চলে এলাম নর্মদা উদ্গম কেন্দ্রে। এখানে দেওয়াল ঘেরা এক বিশাল জায়গার মাঝে নর্মদা নদীর উৎসস্থল ও তা থেকে সৃষ্ট জলাশয়। তার চারপাশ নানান আকার ও আয়তনের সাতাশটি সাদা মন্দির দ্বারা প্রদক্ষিত। আমরা মন্দিরের বাইরে পুজোর উপকরণ কিনে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। দেবী নর্মদার মূর্তি কালো কষ্টি পাথরে নির্মিত। সেখানে পুজো শেষ করে আমরা বাইরে চলে এলাম।
| নর্মদা মন্দির |
এবার চলে এলাম নর্মদার উৎসমুখের সামনে। সেই কোন প্রাচীন সময় থেকে কুন্ড থেকে নর্মতার জল গোমুখনালা হয়ে এসে পড়ছে কোটি তীর্থে। এখান থেকেই প্রবাহিত হয়েছে নর্মদা নদী। অন্য যে কোন নদী উৎসমুখে সরু ও খরস্রোতা হয় কিন্তু নর্মদা উৎস থেকে বেরিয়ে এসে কেমন যেন বদ্ধ , স্রোতহীন, গতিহীন এক স্থির জলাশয়। তবুও এই পূণ্য জলে স্নান করে পুজো দেওয়াই রীতি।
আমরা সারাদিন নর্মদার তীর বরাবর এক মনোরম পথে ঘুরে বেড়ালাম। বাঁদিকে পাহাড় উঁচু হয়ে উঠে গেছে।সবুজে সাজানো রাস্তার ধার। অন্যপাশে অমরকন্টকের মূল জায়গা। রাস্তার একদিকে নর্মদা অন্যদিকে সমতল জায়গা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে পাহাড়ে গিয়ে মিশেছে।
| গ্রামীন বাজার, অমরকন্টক |
এখানে নর্মদার তীরে এক সমতল জায়গায় গ্রামীন হাটের মত বাজার বসে। বেশ সুন্দর লাগছিল দেখতে। বহু মানুষ এই বাজারে কেনাবেচা করছেন।
| নতুন মন্দির কমপ্লেক্স, অমরকন্টক |
নর্মদা মন্দির কমপ্লেক্সের কাছেই আছে সংরক্ষিত বেশ কিছু মন্দির। সুন্দর কারুকার্যশোভিত এই প্রাচীন মন্দিরগুলি হল কর্ণ মন্দির, পাতালেশ্বর মহাদেব। সাজানো পরিচ্ছন্ন এই স্থানে সময় কোন দিকে পার হয়ে গেল টের পেলাম না। আমরা এরপর লজে ফেরত এলাম।
| বরফানি দাদাজী মহারাজের আশ্রম |
বিকেলে সুন্দর একটা চা-পর্ব সেরে সন্ধ্যের মুখে আমরা আমরা চললাম নর্মদা মায়ের আরতি দেখবার জন্য। এই স্থানের প্রায় সব আশ্রমেই মায়ের আরতি হয়। রাত্রে কন্কনে ঠান্ডার মধ্যে আমরা চললাম বরফানী দাদাজী মহারাজের আশ্রমে আরতি দেখবার জন্য। কিন্তু ২৩০ বছরেরও বেশী বয়স্ক এই সাধক এলাহবাদে থাকায় আমরা তাঁর দর্শন থেকে বঞিত হলাম। শুধুমাত্র আশ্রম, তাঁর সাধনাস্থল, আশ্রমের আরতি দেখেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হল।
| মাই কি বাগিচা , অমরকন্টক |
পরের দিন সকালে আমরা গাড়িতে সাইট সিয়িং করতে বের হলাম। পথে পড়ল মাই-কি-বাগিচা। নর্মদামায়ের কিছু সময় নাকি এখানেই কেটেছে। এখানে সুন্দর বাগিচার মাঝে নর্মদামায়ের মন্দির আছে। এখান থেকে খানিকটা দূরে মাই-কি-মন্ডপ। এখানে নর্মদা ও শোনের বিবাহের আয়োজন হয়েছিল।
| মাই কি বাগিচা, অমরকন্টক |
দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম শোনমূড়া। দুইপাশে জঙ্গলঘেরা পথে গাড়ি থেকে নামাই মুস্কিল, এখানে এতো হনুমানের উৎপাত। শোনমূড়া হল শোন নদীর উৎপত্তিস্থল। উৎসস্থল থেকে ক্ষীন নালাপথে বয়ে গিয়ে শোননদী বহু নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এখানে শোনবাবার মন্দিরও আছে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এক অসাধারণ ভিউ পয়েন্ট থেকে সব কিছু দেখে নেওয়া যায়।
| যত বাঁদরামি সোনমুড়াতে |
পাহাড়ি পথে আমাদের গাড়ি আবার এগিয়ে চলে। এবার গন্তব্য কপিলধারা। এটি একটি বিশাল জলপ্রপাত। এখানে নর্মদা সংকুচিত অবস্থায় প্রায় দুশো ফুট উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একটা ভিউ পয়েন্ট থাকলেও আসল সৌন্দর্যের নাগাল পেতে গেলে পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে হবে। তবে এরজন্য শারীরিক সক্ষমতা ও সময় দুটোই থাকতে হবে। আমরা সারাদিন ঘোরার কথা মাথায় রেখে দূর থেকে দর্শনেই সন্তুষ্ট থাকলাম।
| কপিলধারা, অমরকন্টক |
নর্মদার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের গাড়িও এগিয়ে চলে। এবার দেখলাম নর্মদা নদী দুধ সাদা জলস্রোত নিয়ে উপর থেকে নেমে আসছে। কথিত যে দুর্বাশা মুনি দীর্ঘকাল তপস্যার পরে অত্যন্ত ক্ষীণ ও দূর্বল হয়ে পড়েন। তখন নর্মদা দুধরূপে প্রবাহিত হয়ে মুনির প্রাণরক্ষা করেন।
| ভৃগু কমন্ডলু, অমরকন্টক |
এরপর এক জঙ্গলের ধারে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। আমরা পাহাড়ী পথে নীচে নামলাম। দর্শন করলাম ভৃগু কমন্ডলু। এটি মহামুনি ভৃগুর কমন্ডলু বলে এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে আসছেন। একটি বিরাট পাথরের গায়ে একটি মাত্র ছোট গর্ত রয়েছে। সেখানে দিয়ে হাত প্রবেশ করালে জলের স্পর্শ পাওয়া যায়। ঠিক যেন একটা বিরাট কমন্ডলু। এখানে এক প্রাকৃতিক সুরঙ্গের একদিকে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বাইরে আসা যায়। হাতে একটু সময় থাকলে এবং অবশ্যই শরীর সাথ দিলে অমরকন্টকে ঘোরাঘুরির মজাটাই আলাদা। এখানে সব জায়গাই পাহাড়, জঙ্গল, চড়াই, উৎরাই পথে পূর্ণ। বনের মাঝে ঘুরতে ঘুরতেই দর্শন করে নিলাম বহু সাধকের সাধনাক্ষেত্র ধুনিপানি। প্রায় পর্যটকহীন এইস্থানে আমাদের গাইড রয়েছেন আমাদের গাড়ির ড্রাইভারসাহেব।
| ধুনিপানি, অমরকন্টক |
প্রাচীন মন্দিরের পাশাপাশি নতুন নতুন মন্দির গড়ে উঠছে অমরকন্টকে। এই দেবভূমির আকর্ষন এমনই যে বার বার আসতে ইচ্ছা হয় এর টানে। তবুও আপাতত বিদায় অমরকন্টক, এবার আমরা পাঁচমাড়ি পথে।
| অমরকন্টক গাইড ম্যাপ |
কীভাবে যাবেনঃ নিকটতম রেলস্টেশন ছত্তিশগড়ের পেন্ড্রারোড ( অমরকন্টক থেকে দূরত্ব ৪২ কিমি ), কলকাতা থেকে সরাসরি অমরকণ্টক আসতে হলে বিলাসপুর এসে সেখান থেকে বাসে বা ট্রেনে পেন্ড্রারোড আসা যাবে। হাওড়া-মুম্বাই মেল ( ট্রেন নং ১২৮১০ ) সহ নানা ট্রেন বিলাসপুর হয়ে যায়। সড়কপথে অমরকন্টক আসতে হলে ইলাহাবাদ, রায়পুর, বিলাসপুর, কাটনি, জব্বলপুর থেকে সরাসরি বাসে আসা যাবে। বিমানে আসার জন্য নিকটতম বিমানবন্দর জব্বলপুর (২২৮ কিমি) ও ছত্তিশগড়ের রায়পুর(২৩০ কিমি)।
কোথায় থাকবেনঃ হোটেল, লজ বুকিং এর জন্য এখানে ক্লিক করুন
অমরকন্টকের অবস্থান জানতে ক্লিক করুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন