শিল্পগ্রাম রঘুরাজপুর , Raghurajpur- The Heritage Crafts Village
বাঙালীর অন্যতম প্রিয় জায়গা পুরী আমরা সবাই বেশ কয়েকবারই গিয়েছি। জগন্নাথদেবের মন্দির দর্শন, সমুদ্র স্নান, মনের মত খাওয়া দাওয়া ছাড়াও আরেকটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে মনের আনন্দে মার্কেটিং করা। পুরীতে আমরা দোকানে দোকানে নানা রকমের হাতের কাজের ( handicraft ) যে সমস্ত জিনিষ পত্র বিক্রী হতে দেখি তার বেশীরভাগই তৈরী হয় রঘুরাজপুরে। কিন্তু রঘুরাজপুরে কোনদিনই যাওয়া হয় নি। তাই এবারের পুরী ভ্রমণে ঠিকই করেছিলাম রঘুরাজপুর একদিন যাবই।
সেইমত প্ল্যান করে আমরা একদিন দুপুরে গাড়ি করে রঘুরাজপুরের দিকে রওনা হলাম। প্রথমেই বলে রাখি এই গ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ কোন গ্রাম নয়, আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মতই। রঘুরাজপুর পুরী জেলার একটা খুব ছোট গ্রাম, ভার্গবী নদীর দক্ষিন তীরে অবস্থিত। কিন্তু এই গ্রাম ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ম্যাপে এক উজ্জ্বল জায়গা করে নিয়েছে।
আমাদের গাড়ি পুরী থেকে ভূবনেশ্বরগামী জাতীয় সড়ক ধরে এগিয়ে চলল। চলার পথে দুপাশে বালিরতটে ঝাউবনের সৌন্দর্য আমাদের বাড়তি পাওনা হল। প্রায় দশ কিমি আসার পরে আমরা চন্দনপুরে পৌঁছালাম। সেখান থেকে বাঁদিকে রাস্তা ধরে রেল ব্রীজ অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম। চন্দনপুরের ভিতর দিয়ে রাস্তা বেশ সঙ্কীর্ণ ও ভীড়ে ভর্তি, মানুষের ব্যস্ততাও প্রচুর। এরপরে আরও দুই কিলোমিটারের মধ্যেই আমরা রঘুরাজপুরে পৌঁছে গেলাম।
ড্রাইভার সাহেব যখন গাড়ি থেকে নামতে বললেন গ্রাম দেখে খুব হতাশ হলাম। মনটাও খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম- এই গ্রাম দেখার জন্য এতদূর এলাম ? না আছে দেখবার মত বাড়ি ঘর, না আছে শিল্পকর্মের দোকানপত্র। যাই হোক আমরা নেমে একটু এগোতেই একটি কমবয়সী ছেলে আমাদের ডেকে নিয়ে গেল। কাছে গিয়ে জানলাম, এটাই ওদের বাড়ি , সাথে গুরুজী শিল্পকর্মের স্কুল চালান। আমরা বাড়ির মধ্যেকার সিঁড়ি দিয়েই দোতলাতে চলে এলাম। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। চারদিকে নানান শিল্পকর্ম ছড়ানো রয়েছে, দেওয়ালে, মেঝেতে, আলমারীতে কোথায় নেই। কিছু ছাত্র ছাত্রী একমনে শিল্পকর্মের কাজ করে চলেছেন। কি অপূর্ব তাদের হাতের কাজ , না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাদের একাগ্রতা এতটাই বেশি যে আমাদের উপস্থিতিতেও তারা সুন্দরভাবে কাজ করে গেল।
![]() |
| তসরের উপর শিল্পকর্ম |
রঘুরাজপুরে প্রায় একশর উপর ঘর আছে কিন্তু শিল্পীর সংখ্যা তিনশর বেশী। এর মধ্যে আবার অনেকজন আছেন যারা জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত। ভাবতে অবাক লাগে একটা গ্রামের প্রায় সবাই শিল্পী ও শিল্পকর্মের সাথে যুক্ত। এখানকার হাতের কাজে কি স্থান পায় নি ? পটচিত্র শিল্প, তাল গাছের পাতায় শিল্প, পাথরে খোদাই করে শিল্প, কাগজের মন্ড থেকে তৈরী শিল্পকর্ম, কাঠের উপর খোদাই করে শিল্প, তসরের উপর শিল্পকলা। আমরা একেকটা ঘরে যাচ্ছি ও একেক রকমের শিল্পকলা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। এখানে বাড়ির মহিলারাও এই শিল্পকর্মের সাথে যুক্ত। এখান থেকে নানা জায়গাতে এই শিল্পকাজ রপ্তানি হচ্ছে। এখান থেকেও সরাসরি কেনা যায়, আবার অর্ডার দিয়েও কাজ করানো যায়।

শুধুমাত্র ব্যবসাভিত্তিক কাজেই নয় এখানকার শিল্পীরা জগন্নাথদেবের নানা আচার-অনুষ্ঠানের সাথেও যুক্ত। প্রথাগত বিশ্বাসে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা অনুষ্ঠানের পরে তিনি, বলভদ্র ও সুভদ্রা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সময় ভক্তেরা দেবতার দর্শন পান না। এই পর্যায় ‘অনসর’ নামে পরিচিত। এই সময় ভক্তদের দর্শনের জন্য বিগ্রহের পরিবর্তে সিংহাসনে তিনজনের পটচিত্র রাখা হয়। এই পটচিত্র রঘুরাজপুরের শিল্পীরাই তৈরী করে থাকেন। আবার রথযাত্রার সময়ে তিনটি রথের জন্য তিনটি পটচিত্র তৈরী করে থাকেন।
শিল্পকলা দেখতে দেখতে আমরা প্রায় গোটা গ্রামটাই ঘুরে ফিরলাম। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে এত বড় বড় শিল্পীদের সান্নিধ্য, তাদের শিল্পকলা মন ভরিয়ে দিলেও গ্রামের আরো উন্নতি হওয়া দরকার। সন্ধ্যের মুখে আমরা আবার ফেরার রাস্তা ধরলাম। এখন আবার পুরীর সৈকতে।
থাকবার জায়গাঃ পুরীতে রাত্রিবাস, পুরী থেকে রঘুরাজপুর পনের কিলোমিটারের মধ্যে।









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন