বিশ্ব ঐতিহ্যের আরেক বিস্ময়– খাজুরাহোর শিল্পকলা - KHAJURAHO - UNESCO WORLD HERITAGE SITE

 

 

 

KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA


                  ভারতবর্ষের যে কয়টি পর্যটনকেন্দ্রে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বিদেশী পর্যটক ভীড় জমান তার মধ্যে খাজুরাহো অন্যতম। ১৯৮৬ সালে UNESCO এর World Heritage Site এর অন্তর্গত হওয়া এই স্থানটির হাতছানি উপেক্ষা করা ভীষণ কঠিন। তাই আমাদের মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণের শুরুটাই ছিল খাজুরাহো দর্শনের মধ্য দিয়ে।

                         প্রায় ৬০০ বছর বনজঙ্গলে ঢাকা, মাটি চাপা পড়া অবস্থায় আমাদের চোখের আড়ালে লুকিয়ে ছিল বর্তমান খাজুরাহো। ১৯২৩ সালের খননে যখন খাজুরাহোর বিষ্ময়কর ভাস্কর্য লোকচক্ষুর সামনে আসে ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ৮৫ টি মন্দিরের বেশীরভাগই সময়ের সাথে সাথে অযত্নে , অবহেলায় নষ্ট হয়ে মাত্র ২২ টি মন্দির ভারতীয় শিল্পকীর্তির অনন্য নিদর্শন হিসাবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবার জন্য অক্ষত আছে। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় চন্দ্রবংশীয় চান্দেলা রাজারা দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যখন রাজত্ব করেছিলেন সেই সময় খাজুরাহো ছিল তাদের রাজধানী। এই সময়ের মধ্যেই বংশানুক্রমে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই বিষ্ময়কর মন্দিরের সৃষ্টি।  


                          খাজুরাহোর নিকটবর্তী কেন নদীর থেকেই মন্দির ও মূর্তি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এখানকার মন্দির নির্মাণের মূল উপকরণ ছিল উচ্চমানের বেলেপাথর ও গ্রানাইট পাথর। তবে গ্রানাইট ভীষণ কঠিন ও শক্ত হওয়ায় মন্দির নির্মাণে এর ব্যবহার হলেও মূর্তিতে প্রাণ আনার জন্য উচ্চমানের বেলেপাথরই ছিল শিল্পীদের প্রথম পছন্দ। এখানকার মন্দিরগুলির শিখর ত্রিরথা, পাঁচরথা ও সাতরথা শৈলীতে নির্মিত।

                              কোনস্থানে ভ্রমণের আগে তার ইতিহাস ও অন্যান্য তথ্য জানা থাকলে ভ্রমণের আনন্দটাই বহূগুন বেড়ে যায়। শঙ্কুমহারাজের ‘রূপতীর্থ খাজুরাহো’ ও শিবশংকর ভারতীর ‘ভারতের মন্দিরে মন্দিরে’ বইদুটি আমার এই ব্যাপারে খুব কাজে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই খাজুরাহো দর্শন আমার জীবনে এক মনোরম স্মৃতির অধ্যায় হিসাবে সঞ্চিত থাকবে। 

 

          দিন গুনতে গুনতে একটি প্রতীক্ষার অবসান হল।  ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমাদের যাত্রা শুরু। প্রথমে হাওড়া থেকে ট্রেনে সাতনা। খাজুরাহোর নিকটতম রেলস্টেশন সাতনা থেকে খাজুরাহো প্রায় ১১৭ কিমি দূরে অবস্থিত। সাতনা থেকে খাজুরাহো যাওয়ার পথে ঘন্টাকয়েক পান্না অরণ্যের স্বাদ নিয়ে যাব এই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু  হাওড়া ইন্দোর শিপ্রা এক্সপ্রেস প্রায় পাঁচ ঘন্টা দেরীতে  পৌঁছালে পান্না অরণ্য দর্শনের সব স্বপ্ন ওখানেই শেষ হয়ে যায়।   

                        সাতনা রেলস্টেশন থেকে খাজুরাহো পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল । সেই রাত্রে গরম ভাত, চিকেনকারী, আলুপোস্ত দিয়ে ডিনার সেরে সোজা লেপের তলায়। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে খাজুরাহোতে ঠান্ডাটা বেশ উপভোগ্য। পরের দিন সকালে শতাধিক টিয়াপাখির কলরবে ও আমার এক সঙ্গী তরুনের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। আসলে আমাদের হোটেল কৃষ্ণা কটেজের পাশে বিশাল বৃক্ষগুলি টিয়াপাখিদের স্থায়ী ঠিকানা। 

 

                       ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা গাড়িতে ওঠার জন্য তৈরী হয়ে গেলাম। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি এখানকার অক্ষত থাকা ২২ টি মন্দিরকে সঠিকভাবে দেখতে  হলে ২২ দিনও পর্যাপ্ত বলে মনে নাও হতে পারে। খুব কম করে অন্তত দুই রাত কাটাবার পরিকল্পনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA
KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH

 

                         মন্দিরগুলি সমগ্র খাজুরাহো জুড়ে ছড়িয়ে থাকার জন্য এদেরকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেইমত পর্যটকেরা দর্শন করে থাকেন।

 

KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA


পশ্চিমগোষ্ঠীর মন্দিরগুলির মধ্যে রয়েছে - 

৬৪ যোগীনি মন্দির,  লালগুঁয়া  মন্দির, মাতঙ্গেশ্বর মন্দির, বরাহ মন্দির, লক্ষ্মণ মন্দির, বিশ্বনাথ মন্দির, পার্বতী মন্দির, চিত্রগুপ্ত মন্দির, জগদম্বা মন্দির, মহাদেব মন্দির, কান্ডারীয়া মহাদেব মন্দির।

 

পূর্বগোষ্ঠীর মন্দিরগুলি হল-

হনুমান মন্দির, ব্রহ্মা মন্দির, বামন মন্দির, জওয়ারী মন্দির, ঘণ্টাই মন্দির, জৈন মন্দির ।

 

দক্ষিনগোষ্ঠীর মন্দিরের মধ্যে -  দুলাদেও এবং  চতুর্ভূজ মন্দির উল্লেখযোগ্য।


 

               প্রথমেই আমরা পশ্চিম গোষ্ঠীর মন্দির দর্শনের জন্য মূল প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেলাম।  এখানকার মন্দিরগুলির আকর্ষনই সর্বাধিক। এখানে প্রবেশমূল্য লাগে। পুরো জায়গাটি সংরক্ষিত। প্রবেশের আগেই গাইড নিয়ে নিলাম। মূল প্রবেশ তোরনের সামনে একটা অফিসে গাইডচার্জ লেখা আছে।  এখানে গাইডচার্জ দলের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী ধার্য করা হয়। আমরা পুরো দিনের জন্য গাইড নিয়ে নিলাম। গাইডচার্জেও যে দরাদরি হতে পারে সেই অভিজ্ঞতাও হল। দরাদরির কাজটা অবশ্য আমাদের বন্ধু সৌম্য একাই করল। তবে গাইড ছাড়া খাজুরাহো দর্শন করা ও না করা একই। শুধু চোখের দেখা দেখে লাভ কিছু নেই। আমরা মেটাল ডিটেক্টারের নেওয়া পরীক্ষায় পাশ করে ভিতরে প্রবেশ করলাম। নিমেষে চোখ জুড়িয়ে গেল। সমগ্র এলাকাটি অতি যত্নে সংরক্ষন করা হয়েছে। চারদিক সবুজ, তারমধ্যে স্থানে স্থানে মাথা উঁচু করে রয়েছে অতীতের অজানা শিল্পীদের হাতে গড়া বিষ্ময় ও আমাদের গর্ব।

 

KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA

                           দর্শনকালে আমরা পুরোপুরি গাইডের নিয়ন্ত্রনে চলে এলাম। শুরু হল ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা স্থাপত্য, ভাস্কর্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার পালা। সত্যি কথা বলতে কি প্রতিটি মন্দিরের প্রতিটি শিল্পকলার বর্ণনা দেওয়া আমার ক্ষমতার বাইরে। তাই সামগ্রিকভাবে যে সব মূর্তি, শিল্পকলা আমাদের আজীবন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে আমি তাদের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

 

BARAHA TEMPLE, KHAJURAHO , MADHYA PRADESH,INDIA
BARAHA TEMPLE, KHAJURAHO

                             গাইড মহাশয় আমাদের যেখান থেকে দর্শন করানো শুরু করালেন সেটি হল বরাহ মন্দির। চারপাশে দেওয়ালহীন এক ছোট মন্দির। খালি পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে দর্শন করলাম ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের অন্যতম অবতার – বরাহের।  ৯০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল এই মন্দির। শুনে বিষ্মিত হলাম যে পৌনে নয় ফুট লম্বা ও পৌনে ছয় ফুট উচ্চতার বরাহ মূর্তিটি একটি মাত্র পাথরের তৈরী। শুধু তাই নয় মূর্তিটির গায়ে ৬৭৪ টি দেবদেবীর মূর্তি নিখুঁতভাবে খোদাই করা আছে যা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

 

LAKHSMAN TEMPLE,KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA
LAKHSMAN TEMPLE,KHAJURAHO

                            বরাহ মন্দিরের একদম সামনেই লক্ষ্মণ মন্দির। ৯৩০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৯৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে চান্দেলা বংশের যশোবর্মনের দ্বারা নির্মিত এই মন্দিরটি আসলে একটি  বিষ্ণু মন্দির। এর সাথে রামায়নের লক্ষ্ণণের কোন সম্পর্ক নেই। এখানকার সুবিশাল মন্দিরগুলিকে দূর থেকে দর্শনের সময় তার গঠনশৈলীর সৌন্দর্যের স্বাদ একরকম, আবার সেই একই মন্দিরের কাছে এসে দর্শন করলে মন্দিরের গায়ের যে ভাস্কর্য সেই সৌন্দর্যের স্বাদ এক্কেবারেই আলাদা। লক্ষ্ণণ মন্দিরে প্রবেশের সময় এক অদ্ভুদ মূর্তি নজরে পড়ল – একটি সিংহ এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ও তার সামনে বসে এক বীর মানুষ তার সাথে লড়াই করছে। জানা যায় চান্দেলা বংশের বীর রাজা নান্নুক খালি হাতে এক সিংহের সাথে লড়াই করে তাকে শিকার করেছিলেন, সেই থেকে চান্দেলা রাজবংশের প্রতীক হল – সিংহের সাথে যুদ্ধেরত বীর। বীরত্বের প্রতীক এই মূর্তি খাজুরাহো মন্দির প্রাঙ্গনের অনেক জায়গাতেই আছে।


KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA

                               লক্ষ্ণণ মন্দির দর্শন শেষে আমরা হাজির হলাম কান্ডারীয়া মহাদেব মন্দিরের সামনে। ১০১৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১০২৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মহারাজা বিদ্যাধর এই মন্দির নির্মাণ করান। ১০৯ ফুট লম্বা, ৬০ ফুট চওড়া ও মাটি থেকে ১১৭ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন এই মন্দিরের ভিতরে ২২৬ টি ও বাইরে মন্দিরগাত্রে ৬৪৬ টি মিলে মোট ৮৭২ টি মূর্তি আছে যা দেখে অবাক হয়ে যেতে হবেই।   

 

KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA

                             কান্ডারীয়া মহাদেবের দর্শন শেষে একটু এদিক ওদিক ছবি তুলতে না তুলতেই গাইড মহাশয়ের ডাকে চলে এলাম জগদম্বা মন্দিরের সামনে। ৭৭ ফুট লম্বা ও ৫০ ফুট চওড়া এই মন্দির রাজা ঢঙের পুত্র গন্ড নির্মাণ করান। ৭৫ ফুট লম্বা ও ৫২ ফুট চওড়া চিত্রগুপ্ত মন্দিরের প্রধান দেবতা হলেন সূর্যদেব। দর্শন শেষে আমরা বিশ্বনাথ মন্দিরের দিকে পা বাড়ালাম। ১০০২ খ্রীষ্টাব্দে যশোবর্মনের পুত্র ঢঙের নির্মিত এই মন্দির ৮৯ ফুট লম্বা ও ৪৬ ফুট চওড়া।

 

NANDI TEMPLE, KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA
NANDI  TEMPLE, KHAJURAHO

                            বিশ্বনাথ মন্দিরের চত্বরের লাগোয়া মন্দির হল নন্দীমন্দির। মন্দিরের ভিতর আকর্ষনীয় বৃষমূর্তিটি লম্বায় সোয়া ৭ ফুটো উচ্চতায় ৬ ফুট। শুনলাম এই বৃষমূর্তির কানের কাছে প্রার্থনা করে যা চাওয়া হবে তাই পাওয়া যাবে। সেইজন্য বৃষমূর্তির গলা জড়িয়ে ভক্তদের ভীড় লেগেই রয়েছে।   

 

KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA

                             মন্দিরগুলির শিল্পভাস্কর্য এককথায় অসাধারণ, মনোরম, প্রানবন্ত, মনোমুগ্ধকর। খাজুরাহ শিল্পকলাগুলির রূপের ছটা যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে তা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তক্‌মা পাওয়া দেখেই বুঝতে পারা যায়। কিন্তু সেই জৌলুষের আঁচের উষ্ণতা পেতে হলে এসে দাঁড়াতে হবে মন্দিরের সামনে। কি নেই এখানকার শিল্পকলায় ! মানব জীবনের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞের প্রতিটি দৃশ্যই নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানকার মূর্তিগুলিতে। শিল্পীদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় তা হয়ে উঠেছে জীবন্ত। সেই সময়কার মানুষদের শিকারযাত্রা, শোভাযাত্রা, আমোদপ্রমোদ , রনসাজে সজ্জিত সেনাবাহিনী, নৃত্যগীতরত নারীপুরুষ, কর্মব্যস্ত শ্রমিক -  সেই সময়কার সমাজজীবনের জীবন্ত ছবি হয়ে আছে।       

 

KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA
KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA


                            তখনকার নানান জীবজন্তু যেমন ঘোড়া, হাতিকে নানা কাজকর্মের মাধ্যম হিসাবে দেখানো হয়েছে, আবার পশু পাখিদের অনুভূতিকেও মর্যাদা দিয়ে শিল্পকলা করা হয়েছে।  আবার অন্যদিকে নাগিনকন্যা, অপ্সরা, কীচকের মূর্তি, হরপার্বতী, রামসীতাসহ অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তিও এখানকার ভাস্কর্যের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। এখানকার নারীপুরুষের মূর্তির জীবন্ত রূপ দিতে শিল্পীদের দক্ষতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মূর্তিগুলির শরীরের প্রতিটি অঙ্গের শারীরিক অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখে এদেরকে মূর্তি বলে মনে হয় না। আলাদাভাবে নারী মূর্তির বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যেমন তাদের দেহের গঠন তেমনি অপরূপ ভঙ্গিমা। এ যেন রকমারী ভঙ্গিমায় নারীমূর্তির এক অনুপম প্রদর্শনী যা যোগ যোগ করে করে সুবিশাল মন্দিরের রূপ দিয়েছে।  

 KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIAKHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA

                                ঘুরতে ঘুরতে এক নারীমূর্তির সামনে এসে গাইড বললেন- মূর্তিটি সামনে থেকে দর্শন করলে দেখবেন মুখ গম্ভীর অথচ পাশ থেকে দেখলে হাস্যময়ী বলে মনে হয়। সত্যিই ভারী আকর্ষণীয় এই মূর্তি ! পশ্চিমগোষ্ঠীর মন্দিরগুলির মূর্তিগুলিতে মিথুন মূর্তির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। পুরুষ ও নারীর দেহমনের যাবতীয় কামনা , বাসনা ও অনুভূতির এক মনোরম প্রস্তুরীভূত রূপ শিল্পীদের নিপুন হাতের কারসাজিতে প্রাণের স্পর্শ পেয়েছে। প্রাকৃতিক কারণেই নরনারীর আকর্ষণের যে নানান রূপ, তাদের ভাব ভালবাসার অনুভূতি ও কামকলার যে বাহ্যিক প্রকাশ, তার প্রতিটি পর্বের নিখুঁত, সুন্দর মূর্তি চোখ টানতে বাধ্য। ছেনী বাটালির সুক্ষ্ম স্পর্শে যে নারী পুরুষের  অনুভূতির প্রতিচ্ছবিও ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে তা সামনে থেকে না দেখলে বিশ্বাস  করা কঠিন। সঙ্গমরত নরনারীর মূর্তিগুলি এতটাই প্রাণবন্ত ও তাদের এমনই অনিন্দসুন্দর ভঙ্গিমা যে আইপ্যাড হাতে আধুনিকা বিদেশীনিকেও থমকে দাঁড়িয়ে বিষ্ময়ে চেয়ে থাকতে  দেখেছি। 

 
KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA

                          মিথুন মূর্তি ছাড়াও সিক্তবসনা সুন্দরী নারী, দর্পনের সামনে প্রসাধনরতা সুন্দরী, পায়ে বিদ্ধ হয়ে যাওয়া কাঁটাকে তোলার ভঙ্গিমাতে নারী – এদের সৌন্দর্য চিরকালের জন্য মনে রয়ে যাবে। তবে একটা কথা জোড়ের সাথেই বলা যায় যে এখানকার নারী মূর্তির ভাস্কর্যে যে অনিন্দসুন্দর স্বাস্থ্য – উন্নত বক্ষ, সঙ্কীর্ণ কটিদেশ নিয়ে শারীরিক গঠন; পেশীর ভাঁজ, অপরূপ মুখশ্রী, রূপলাবণ্য, কেশবিন্যাস, হাত, পা, গলা, কোমড়, কান, নাকের অলংকারসজ্জা; বেশভূষা, ব্যবহৃত প্রসাধনদ্রব্য শিল্পীদের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় এতটাই প্রাণবন্তভাবে ফুটে উঠেছে যে বর্তমান যুগের বিউটিপার্লারগামী আধুনিকারও ইর্ষা হতে বাধ্য।   

   

KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA

                পশ্চিমগোষ্ঠীর মন্দির দর্শন শেষ করে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য হোটেলে ফিরে আসতেই হল। গাইড মহাশয় খাওয়া সেরে আমাদের হোটেলে চলে আসবেন বলে একটা ব্যবস্থা হল। খাওয়া পর্ব মিটিয়ে আমরা পূর্বগোষ্ঠীর মন্দির দর্শনের জন্য চললাম। মূলত বামন মন্দির ও জৈন মন্দির নিয়ে পূর্বগোষ্ঠী। জৈন মন্দির অনেকগুলো তীর্থঙ্করের মন্দির নিয়ে সজ্জিত। পূর্ব ও দক্ষিনগোষ্ঠীর মন্দির দর্শনের জন্য কোন প্রবেশমূল্য দিতে হয় না। দর্শনার্থীও পশ্চিমের তুলনায় কম। দক্ষিনের মন্দিরের মধ্যে দুলাদেও ও চতুর্ভূজ মন্দির বিখ্যাত। চতুর্ভূজ মন্দিরের বিষ্ণুমূর্তি একটু অন্যরকম – এই মূর্তির পা থেকে কোমর কৃষ্ণ, কোমর থেকে নারায়ণ ও মাথায় শিব। পশ্চিমগোষ্ঠীর মন্দিরগুলির তুলনায় এখানকার মন্দিরগুলো অনেকটাই জৌলুষহীন বলে মনে হয়।     

 

VISHNU  SCULPTURE, KHAJURAHO TEMPLE, MADHYA PRADESH,INDIA
GOD  BISHNU

                সূর্যাস্তের সময়ে আমরা গাইডকে বিদায় দিয়ে লজে ফেরত এলাম। এসেই আবার ব্যস্ততা। বাইরে যতই ঠান্ডা থাক light and sound show না দেখলে খাজুরাহো বেড়ানো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চনের ধারাভাষ্যে সন্ধ্যে সাতটায় যে শো আমরা দেখলাম তাতে গায়ে কাঁটা দিয়ে গেল। ধারাভাষ্য ও আলোছায়ার যাদুতে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম চান্দেলা  রাজত্বের সময়ে।

 কোথায়  থাকবেনঃ  Click on MP TOURISM HOTEL

                            

 কিভাবে  যাবেনঃ  খাজুরাহোর নিজস্ব একটা এয়ারপোর্ট আছে, সেটা প্রায় দুই কিমি দূরে অবস্থিত। বারাণসী, দিল্লী, ভূপাল, মুম্বাই থেকে আসা যাওয়া করা যায়। খাজুরাহোর নিকটতম রেল স্টেশন মাহোবা ৬৩ কিমি দূরে অবস্থিত। ভারতের প্রায় সব বড় বড় স্টেশনের সাথে যুক্ত। এছাড়াও পাশাপাশি শহর থেকে বাস যোগাযোগ আছে।

মন্তব্যসমূহ