খোয়াইয়ের হাট থেকে 'আমার কুটিরে'
![]() |
| সাঁওতাল নৃত্যে পা মিলিয়েছে সবাই, সোনাঝুড়ি, খোয়াই হাট |
শীতের এক সকালে আমরা বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি থেকে গাড়িতে চললাম বোলপুর-শান্তিনিকেতন রোড ধরে। প্রথমে চললাম খোয়াইয়ের হাটে, তারপরে ফেরার পথে ‘আমার কুটির’। মাত্র এক ঘন্টাতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ‘খোয়াই-এর হাট’। ‘খোয়াই’ লালমাটির বুকে প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। বয়ে যাওয়া জলধারার ঘর্ষণে লাল মাটি ক্ষয়ে গিয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। সেই জায়গা শীতল করে রেখেছে শিমূল, শাল, পলাশ, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপ্টাসের বন। এখানে প্রকৃতির কোলে একটা গোটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। এখানকার বাড়তি পাওনা আশেপাশের গ্রাম থেকে নানা মানুষ নিজেদের হাতে তৈরী নানান দৈনন্দিন কাজের জিনিষপত্র ও শৌখিন দ্রব্য সাজিয়ে নিয়ে এসে গ্রামীন হাটে দোকান দেন।
আমরা গাড়ি থেকে নেমে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গেলাম। জায়গাটার নাম সোনাঝুরি। ছায়ানিবিড় জায়গাতে চারিদিকে পসরা সাজিয়ে গ্রামের বিক্রেতারা বসে আছেন। গায়ের চাদর, স্টোল, পাঞ্জাবী, কুর্তি, কাঠের, বাঁশের তৈরী হস্তসামগ্রী। এছাড়াও হাতে আঁকা কবিগুরুর নানান ছবি। এক্কেবারে পিছন দিকে গ্রাম্য থিমে গড়ে উঠেছে থাকবার লজ ও খাবার রেস্তোরা। এইসব লজ ও রেস্তোরার ব্যবস্থাপনা দেখলে অবাক হতে হয়। আমরা একটি রেস্তোরাতে কি কি খাব তার অর্ডার দিয়ে আগাম পেমেন্ট করে দিলাম। তারপর থেকে চিন্তামুক্ত ঘোরাঘুরি।
ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটু ভীড় দেখে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম সাঁওতাল নৃত্য। যেমন মনোরম প্রকৃতি তেমনই মানানসই ওদের নাচ, কোথাও কৃত্রিমতার চিহ্ন অবধি নেই। বাড়তি পাওনা ওদের হাত ধরে ওদের সাথে পা মেলানো। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি ‘আগন্তক’এর শেষ দৃশ্যে মমতাশঙ্করের সাঁওতালদের সাথে নাচের কথা মনে পড়তে বাধ্য। যাদের মনে সাঁওতালদের সাথে নাচ করার বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল , এইখানে তাদের মনবাসনা পূরণ হতে বাধ্য।
অবশেষে পেটের টানে আবার ফিরে আসতে হল। কাঁসার থালা, কাঁসার বাটিতে কাঠ ও মাটি দিয়ে সাজানো রেস্তোরাতে দুপুরের খাওয়া সারলাম। এবার ফেরার পালা। সামান্য দূরেই দুই কিমির মধ্যেই ‘আমার কুটির’। গাড়ি ছুটল সেই দিকে।
![]() |
| এখানেই আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম, খোয়াই হাট |
খানিকটা যেতে না যেতেই মূল রাস্তা থেকে বাঁদিকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লালমাটির পথ চলে গেছে। শাল, সেগুনে ঘেরা এই জায়গাতেই ঘরে উঠেছে ‘আমার কুটির’এর কর্মকান্ড। বাঁদিকে তৈরী হয়েছে থাকবার জন্য আধুনিক রিসর্ট। তারপরেই রকমারী গাছপালা ঘিরে গড়ে উঠেছে ইকোপার্ক। প্রবেশমূল্য কুড়ি টাকা হলেও সেরকমভাবে এখনো পার্কটি গড়ে ওঠেনি।
![]() |
| আমার কুটির, শো-রুম, সামনের দিকের ছবি |
‘আমার কুটির’ আসলে কোপাই নদীর তীরে বল্লভপুর গ্রাম। শান্তিনিকেতনের হস্তশিল্পের আঁতুরঘর বললেও ভুল হবে না। মূল কর্মকান্ড জড়িয়ে আছে ‘আমার কুটির সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’কে কেন্দ্র করে। বাটিকের কাজকরা রকমারী চামড়ার ব্যাগ, ঘর সাজাবার জন্য নানান চামড়ার দ্রব্য, সালোয়ার কামিজ, কাঁথাস্টিচ শাড়ী, বাঁশের তৈরী নানান সৌখিন দ্রব্য এখানে বিখ্যাত। এখানকার হস্তশিল্প ও চর্মজাত সামগ্রী এক বিশেষ ঘরানার, যার জন্য ভারতবর্ষের যে কোন প্রান্তেই তাকে ‘শান্তিনিকেতনের শিল্পদ্রব্য’ বলে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। এখানে সমস্ত শিল্পদ্রব্য তৈরীর পাশাপাশি বিক্রয় করারও সুবন্দোবস্ত আছে।
![]() |
| আমার কুটির শো রুম |
‘আমার কুটির’এর এই শিল্পকলা আজকের নয়। পরাধীন ভারতে এইস্থানে হস্তশিল্পের সূচনা করে ছিলেন স্বদেশী বিপ্লবীরা। এর মূল লক্ষ্য ছিল স্বদেশী বিপ্লবীদের কর্মের মাধ্যমে আশ্রয়দান। সুতির বস্ত্র ছাপানোর একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এর জন্ম। চামড়া ও অন্যান্য হস্তশিল্পের কাজ পরে শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথও সূচীশিল্পের এই কাজে যথেষ্ঠ উৎসাহ দান করেছিলেন। সুরুল গ্রামের জমিদার অশ্বিনী সরকারের দান করা ২৫ বিঘে জমিতেই সুষেন মুখার্জী ১৯২৩ সালে ‘আমার কুটির’এর সূচনা করেন। ১৯৩২ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশ্রয়দানের অপরাধে আমার কুটিরের কাজকর্ম ব্রিটিশ পুলিশ বন্ধ করে দেয় ও স্বাধীনতা সংগ্রামী সুষেণ মুখার্জিকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কারাগারে কাটাতে হয়।
স্বাধীনতার পরে ‘আমার কুটির’ এর মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে গ্রামীন কুটির শিল্পের উন্নতি ও দেশের মানুষদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। অবশেষে প্রাক্তন বিপ্লবী ও সমাজসেবী পান্নালাল দাশগুপ্তের প্রচেষ্টায় ১৯৭৮ সালে তৈরী হয় ‘আমার কুটির সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ । তখন থেকেই এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গ্রামীন হস্তশিল্প বিকাশে প্রশিক্ষণ, উৎপাদন ও বিক্রয়ে সাহায্য করে আসছে।
![]() |
বিক্রয়কেন্দ্রে প্রবেশ করার সময় ডানদিকে দেখতে পেলাম বিখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের হাতে তৈরী রবীন্দ্রনাথের সুদৃশ্য এক বিশাল মূর্তি। এই খানে এই একটিই বিক্রয়কেন্দ্র। আগে একতলা থাকলেও বর্তমানে দোতলা শো-রুম। শীতের মিঠে রোদে গোটা জায়গাটি ঘুরে দেখাটা বেশ আনন্দদায়ক। এখানে গাড়ি রাখারও জায়গা আছে, কোন অসুবিধা নেই। এখানকার শো- রুম খোলা থাকে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যে ৬ টা পর্যন্ত এবং অক্টোবর থেকে মার্চ মাসে সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫-৩০ টা পর্যন্ত। তবে সুষেন মুখার্জীর মৃত্যু দিবস উপলক্ষ্যে ৫ই ও ৬ই জুন শো-রুম বন্ধ থাকে। শুধু এখানকার মানুষই নন , সমগ্র বীরভূম জেলার প্রচুর মানুষ এই শিল্পের সাথে যুক্ত হয়ে একে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন।
কীভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে বোলপুর আসার প্রচুর ট্রেন আছে। এছাড়াও চলে কলকাতা সিউড়ি ( ভায়া বোলপুর ) এসি ভলভো বাস। বোলপুর শান্তিনিকেতন থেকে মাত্রই কয়েক কিলোমিটার দূরে খোয়াই-এর হাট ও ‘আমার কুটির’।
‘আমার কুটির’ যোগাযোগের ঠিকানাঃ
ফোন – ৯৭৩৪৩৬৮০৫০ / ৯৪৩৪১৪২৫৪১
ই-মেলঃ amarkutir1923@rediffmail.com,
কলকাতা অফিসের ফোন নং ০৩৩-২৫৩০২৬৭৯
কোথায় থাকবেনঃ শান্তিনিকেতন এলাকায় প্রচুর বেসরকারী লজ আছে। এছাড়া আছে সরকারী লজ।
খোয়াইয়ের হাটে বেশ কিছু থাকার ও খাবার জায়গা আছে। তার মধ্যে একটা রিসর্টের ঠিকানা নীচে দিলাম - রাম শ্যাম ভিলেজ রিসর্ট, যোগাযোগ- ৭০৭৬৩১৯৬৬৪ /৬২৯৭৮৭২৯৭৭
ওয়েব পেজ - www.ramshyamvillageresort.com , এসি ডবল বেড -২০০০ টাকা, এসি ফোর বেড ৩৫০০ টাকা ( জি এস টি বাদে )





মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন