শুভবিজয়াঃ চিঠি থেকে টেলি চিঠি
মায়ের এবার ফেরার পালা। সকলকে শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। মহালয়াতে যেমন রেডিওর কথা খুব মনে পড়ে, তেমনি শুভ বিজয়া জানাতে গিয়ে আজ খুব মনে পড়ছে পোষ্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, খামের কথা। তাই আজকে সেই পুরনো দিনের কিছু কথা , কিছু গল্প নিয়ে আমার এই লেখা।
বিজয়া দশমীর দিন মা দুর্গার প্রতিমা ভাসান দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ‘শুভ বিজয়া’ জানানোর পালা । প্রণাম, কোলাকুলি, আশীর্বাদ প্রদানের মধ্য দিয়ে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করাটাই প্রথা। বাঙালীর ‘শুভবিজয়া’র সংস্কৃতির মহিমা এমনই যে সারা বছরের তিক্ততা, শত্রুতা, মনমালিন্যতাকে দূর করে দেয় সামান্য কোলাকুলি ও মিষ্টিমুখের এই রীতি। গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিতে এটাই দেখতে পাওয়া যেত যে - মা দুর্গার প্রতিমা ভাসানের পরে দশমীর দিনই রাত্রে গ্রামের প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে বড়দের পা ছুঁয়ে প্রনাম করতেন ও বাড়িতে আসা অতিথিদের মিষ্টি মুখ করাতেন। আসলে তখন শুভবিজয়ার উৎসব মানেই ছিল মিলন মেলা। তবে এসব কিছুই কাছে থাকা মানুষদের জন্য। দূরে থাকা প্রিয়জনদের শুভ বিজয়ার প্রীতি, শুভেচ্ছা, প্রণাম, ভালোবাসা, স্নেহ জানিয়ে চিঠি লেখা শারদ উৎসবের পরে বাঙালীর সংস্কৃতির একটা অঙ্গ, যা কিনা ‘বিজয়ার চিঠি’ নামেই বেশী পরিচিত। বর্তমান প্রজন্মের কাছে শব্দ দুটি শুধু অচেনাই নয়, বাঙালীর এই সংস্কৃতিও তাদের কাছে অজানা অচেনা। আর যারা একটু পুরানো মানুষ তারা এই সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হলেও এখন ভুলতে বসেছেন। অথচ আটের দশকের শেষ পর্যন্ত ‘বিজয়ার চিঠি’ লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বাঙালী সংস্কৃতি ছিলো। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করার জন্য এই চিঠির তুলনা মেলা ভার।
বিজয়ার চিঠি লেখার প্রস্তুতির জন্য দুর্গাপুজোর আগেই পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, খাম, ডাক টিকিট সব জোগাড় করে রাখতে হতো। কারণটা ছিলো - অনেক সময়ই এমন হয়েছে যে পুজোর পরে অতিরিক্ত চাহিদার জন্য এইগুলি অমিল হয়ে যেত ডাকঘরে। তাই ছোটতে পুজো শুরুর আগেই দেখতাম আমার বাবা পোস্টকার্ড, খাম ও কিছু ডাক টিকিট কিনে রেখে দিতেন, পরে সেই দায়িত্ব এসে পড়েছিল আমার উপরে। বাড়িতে একটি নোটবুকে সমস্ত আত্মীয়, বন্ধু ও চেনা মানুষদের ঠিকানা লেখা থাকত। আরো কাউকে চিঠি লেখার দরকার থাকলে বা কারো ঠিকানা পরিবর্তন হলে তার ঠিকানা জোগার করে এই নোটবুকে লিখে রাখতে হতো। যারা কাছে থাকতেন সেইসব মানুষদের বিজয়াপ্রণাম, শুভেচ্ছা সশরীরে জানানো গেলেও বাকী দূরের সকলকে ছোট বড় নির্বিশেষে চিঠির মাধ্যমেই শুভবিজয়া জানানো হতো। প্রিয়জনদের হাতে লেখা সেইসব চিঠি পাওয়ার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেন। অতি যত্নে লেখা এই চিঠিতে তাদের হাতের লেখার মধ্যেই প্রিয়জনেরা তাদেরকে কাছে পেয়ে যেতেন। প্রণাম, স্নেহ, ভালবাসা, আদর, শুভেচ্ছা যেন চিঠিতে লেখা প্রতিটি শব্দের মাধ্যমে প্রাপকের অন্তর ছুঁয়ে যেত। পোস্টকার্ডের সীমিত জায়গায় সকলের লেখার জায়গা হত না, সকল কথা লেখার জায়গাও থাকত না। এমনও দেখা গেছে পোস্টকার্ডের ধারে ধারে খুদি খুদি হরফেও কিছু কথা লেখা থাকত। বড়রা লেখার পরে একটু জায়গা দিয়ে বলত- ‘তোর জন্য একটু জায়গা রেখেছি, দু লাইন লিখে দে’। তাতেই নিজেকে বড় বড় মনে হতো। ইনল্যান্ড লেটারে অবশ্য লেখার জায়গা অনেকটা থাকত, চিঠি না খোলা অবধি পড়া যেত না। আমার এক বন্ধু ইনল্যান্ড লেটারের বাইরে প্রেরকের ঠিকানা লেখার জায়গায় নিজের ঠিকানা না লিখে লিখত ‘ বলত আমি কে ?’ এইগুলো ছিল চিঠি পাওয়ার বাড়তি মজা। চিঠি ছাড়াও মা দুর্গার ছবি দিয়ে সাজানো গ্রিটিংস কার্ড পাঠানোর রীতিও ছিল বন্ধুমহলে ও অফিসে।
গুরুজনদের “শ্রীচরনেষু” , ছোটদের “স্নেহের”, সমবয়সীদের “প্রীতিভাজনেষু” সম্ভাষণ জানিয়ে চিঠি লেখা হতো। স্কুলে বাংলার ক্লাশে “পত্রলিখন” শেখার অনেক আগেই বাড়িতে বিজয়ার চিঠিতে ছোটদের হাতে খড়ি হয়ে যেত। অন্যদিকে বড়দের কাছ থেকে পাওয়া দুইলাইনের বিজয়ার চিঠিও ছোটদের মন ভরিয়ে দিত। দশমীর পর থেকে দীপবলির আগে পর্যন্ত প্রত্যেকেই অধীর আগ্রহে ডাকঘরের পিয়নের জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন। এই সময় এমন মানুষের চিঠিও হাতে পাওয়া যেত, যার সাথে সারা বছরে এই সময়েই একবার যোগাযোগ হতো।
এরপর ধীরে ধীরে সমাজ জীবনে থাবা বসালো টেলিবিপ্লব। নব্বই দশকের প্রথম দিকে ল্যান্ড টেলিফোন বাড়ীতে অবাধে প্রবেশ করার সাথে সাথে টেলিফোনে ‘শুভবিজয়া’ সেরে ফেলার ব্যাপারটাও চালু হয়ে গেল। সারাদিন মানুষ অপেক্ষা করে থাকতেন কখন টেলিফোনের কলচার্জ অর্ধেক বা একতৃতীয়াংশ হবে, তাতে একটু হলেও বেশী কথা বলা যাবে। ল্যান্ড টেলিফোনের পাশেও বাড়ির সবাই অপেক্ষা করে থাকতেন একটিবার কথা বলার সুযোগ পাওয়ার জন্য। তবুও এই নতুন টেলি বিজয়া কলম দিয়ে লেখা চিঠির জায়গা দখল করে নিতে পারেনি। এরপর কয়েক বছরের মধ্যে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে এলো সেলফোন ( মোবাইল ফোন ) । তখন থেকে বিজয়ার যাবতীয় অনুভূতি প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠল মোবাইল ফোনের ‘এস এম এস’ ও ভয়েস কল। তখনও চিঠি লেখার অভ্যাসকে পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি কেউই। ‘এস এম এস’ এর পাশাপাশি গুরুজনদের প্রণাম জানিয়ে চিঠি লেখার চলও ছিল। এরপর প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতিতে স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ হাত আসাতে শুধুমাত্র বিজয়ার চিঠি নয়, যে কোন রকম চিঠি লিখতেই ভুলে গেলেন সবাই। ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল পোস্টকার্ড, খাম, ডাকটিকিট, কাগজ, কলম, কালি। এখন ই-মেল, এস এম এস, চ্যাটিং, নানান সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইট হচ্ছে বিজয়া করার আদর্শ জায়গা। এদের মাধ্যমে প্রত্যেকে নিজেদের ছবি, নিজেদের কন্ঠস্বর, লেখা, পুজোর ভিডিও সমেত শারদীয় উৎসবের সমস্ত অনুভূতির টাটকা খবর নিমেষের মধ্যে সকলের সাথে ভাগ করে নিতে পারেন। এখন বোধহয় শখ ছাড়া আর হাতে লিখে ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠি কেউ পাঠান না। সময়ের সাথে সাথে মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। আগে বিজয়ার চিঠি দীপাবলির পরে পেয়েও অস্বাভাবিক বলে মনে হতো না। কিন্তু আজ যদি বিজয়ার একটা শুভেচ্ছাবার্তা কেউ কালীপুজোতে পান, কেমন বেমানান লাগবে ভাবুন তো !
তবুও মনে হয় যত সুবিধাই টেলি প্রযুক্তিতে থাক না কেন ডাক ঘরের মাধ্যমে পাওয়া চিঠির আনন্দ ছিল আলাদা। প্রিয় মানুষটার হাতে লেখা চিঠিতে তার ছবি যেন সামনে ভেসে ওঠে। তার সেই জায়গার ডাকঘরের সীলমোহর, ডাক টিকিট, তার নিজের হাতে লেখা ঠিকানা, প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য যেন তার কন্ঠে শুনতে পাওয়া যায়, তার স্পর্শের অনুভূতিও টের পাওয়া যায়। আসলে শত সুবিধা থাকা সত্বেও টেলি মাধ্যম কখনোই চিঠির বিকল্প হতে পারবে না কারণ একটাই – টেলি মাধ্যমে সবকিছুই ডিজিট্যাল যেখানে প্রিয়জনের স্পর্শের বড়ই অভাব যে । তবে সময়ের সাথে সাথে বিজয়া দশমীর প্রনাম, শুভেচ্ছা জানানোর পদ্ধতির বিবর্তন হলেও বাঙালির জীবনের সাথে আজীবন জড়িয়ে থাকবে বিজয়া দশমী।

ভালো থেকো l
উত্তরমুছুনপূজার পর বিজয়ার ব্যাপার টা পড়লাম l তুমি এত পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লেখো কি করে সেটা মনে হয় আমার এ জীবনে বোধগম্য হবে না l তোমার লেখাটা পড়ে পুরানো সব স্মৃতি মনে পড়ছে l এবং দেখলাম কোন কিছু বাদ ও দাও নি l যেমন post card এর উল্টো একটু ছোট জায়গায় তে কিছু লেখা , sms, greeting card ইত্যাদি l মাঝে মাঝে এই রকম লিখলে পুরোনো স্মৃতি গুলো আবার চেগে উঠবে l ভালো ও সুস্থ থেকো l
উত্তরমুছুন