মানস ভ্রমণ – টাইম মেশিনে করে চার দশক আগে

 

autumn season, kash flower, green nature, white flower,


বাঙালী, যার কিনা পায়ের তলায় সর্ষে, সে আজ অদৃশ্য বেড়াজালে আবদ্ধ নিজের বাড়িতে দিনের পর দিন নিয়মের বেড়াজালে থেকে কখন যে বসন্তের পলাশ ফুল ঝরে গিয়ে শরতের কাশবনে দোলা লাগল আমরা টেরই পেলাম না বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া তো স্বপ্ন, নিজের বাড়ির সামনের পার্কটাতে যেতে গেলেও হাজারো নিয়ম তাই ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে মানস ভ্রমণ ছাড়া আর কোন উপায় নেই স্মৃতি সবসময়ই সুখের তাই জঙ্গলের বুনো গন্ধ, পাহাড়ের শীতলতা, সমুদ্রের নোনা আদ্রতা, অতিথিশালার উষ্ণ অভ্যর্থনা,  হেরিটেজ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আকাশছোঁয়া গর্ববোধ করা থেকে আমরা বঞিত হলেও মানস ভ্রমণের  আনন্দ থেকে কেউ সরিয়ে রাখতে পারবে না প্রিয়জনদের সাথে ঘোরাঘুরির ছবিদেখে, স্মৃতি রোমন্থন করে, দুধের স্বাদ কিছুটা হলেও ঘোল দিয়ে মেটাতে পারি তাই আজকে স্মৃতির পাতা দিয়ে গাঁথা বইটার মলাট থেকে সময়ের ধুলো সরিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রায় চল্লিশ বছর আগে      


 

               হ্যাঁ, ঠিক এই সময়ে, মহালয়ার পরেই আমার বন্ধুরা সবাই যখন পুজোর সময় পাহাড়, সমুদ্র দেখতে নানান দিকে বেড়াতে চলে যেত, আমরা যেতাম গ্রামের বাড়ি পারিবারিক দুর্গাপুজোর টানে সেটা ছিল এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণ সারাবছর শহরে কাটিয়ে পুজোর সময় কিছুদিন গ্রামে থাকা আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম এই ভ্রমণের জন্য মজা ও আনন্দের শুরু ছিল মহালয়ার দিন থেকেই। সেদিন থেকেই আমরা লেখাপড়ার পাততারি গুটিয়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে যেতাম। মহালয়ার দিন সকালে গ্রাম থেকে গোরুর গাড়ী আসত আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাতে বিছানা বিছিয়ে ,বালিশ সাথে দিয়ে আমরা দাদুর সাথে চলে যেতাম গ্রামের বাড়ি। সতেরো কিমি রাস্তা পাড়ি দিতাম প্রায় চার ঘন্টায়। এখন মানুষ পাগল হয়ে যাবে কিন্তু আমাদের তখন সময়টা কম বলে মনে হত। পথে ফুল, নদী, কাশ ফুলের দোলা, পাখির ডাক আমাদের সম্মোহিত করে রাখতআমাদের বাড়তি পাওনা ছিল পালা করে একবার গোরুর  গাড়ি চালাবার সুযোগ।  এছাড়া দাদুর ছেলেবেলাকার গল্প শোনাতো ছিলই  

 


                         গ্রামের বাড়ি পৌঁছে মনে হত আমরা স্বাধীন হলাম। এক ছুটে দেখতে যেতাম প্রতিমা কতটা তৈরী হয়েছে। চোখের সামনে একটা বিশাল একচালার প্রতিমা গড়ে উঠত কদিনের মধ্যেই। প্রতিমার কাজ কতটা এগুলো সে খবর বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকা মা, জ্যেঠিমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা আমাদের কাজ ছিল। বাড়িতে তখন কাজের ব্যস্ততা। কাঠের আগুনে রান্না, পুজোর জোগাড়, পাশাপাশি পুজোতে আমাদের খাবারের  জন্য তৈরী হত মুড়কি, খৈ-বিন্দু, আড়ষে, সিউয়ের লাড্ডু ইতাদি। এই কদিন বাঁধন ছাড়া হওয়াতে ছিপ হাতে পুকুরে    গামছা দিয়ে নদীতে ছোট ছোট মাছ ধরার ব্যার্থ চেষ্টা করতাম। তাতে মায়ের মানা ছিল না, শুধুমাত্র এই কদিনের জন্য। যত রকমের অতৃপ্ত বাসনা ও আবদার মেটাবার জায়গা ছিল আমার গ্রামের বাড়ি     

                             দেখতে দেখতে পঞ্চমী চলে আসত। সেদিন মাদুর্গাকে ডাকের সাজে সাজিয়ে , অস্ত্র হাতে দিয়ে বেদীতে তোলা হত। আমরা বড়দের সেই কাজের সাক্ষী থাকতাম। এরই মধ্যে বড় কেউ যদি কোন কাজ আমাদের করতে বলত , আমরা ধন্য হয়ে যেতাম।   


 

                               মহাসপ্তমীতে  আমাদের গ্রামের রীতি অনুযায়ী সহস্রধারা দিয়ে পথ পরিস্কার করে কুসকর্ণিকা নদী থেকে দোলাতে করে ঘট আনা হত। সহস্রধারা ব্যাপারটা হল – একটি মাটির হাঁড়ি, তাতে অসংখ্য ফুটো করা থাকে, সেটি একজন জল ভর্তি অবস্থায় মাথায় করে নদী থেকে নিয়ে আসেনসেই হাঁড়ি থেকে অসংখ্য জলধারা পথ পরিস্কার করতে থাকে ও পিছনে পিছনে আসে দোলা ও ঘট। গ্রামের প্রচুর মানুষ সেই সহস্রধারাতে জল ঢালতে থাকেন যাতে সেটি জলশূন্য না হয়ে যায়। মন্দিরে এসে প্রবেশের আগে হত বাতাসা হরিলুঠ। বাতাসা সংগ্রহের কায়দা কানুনে জমে উঠত পুজো মন্ডপ।     


 

                                  আমাদের গ্রামে তখন বিদ্যুৎ আসেনি। মহা অষ্টমীর পুজোর সময়  যদি রাতে হত তাহলে এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি হত। গোটা গ্রাম অন্ধকার, হ্যাজাকের আলোয় শুধু মায়ের  আলোকিত মূর্তিদূরে বিন্দুর মতো আলোগুলো দেখিয়ে বাবা বলতেন – ঐগুলো সব বিভিন্ন গ্রামের পুজোর আলো, ঐটা গ্রামারকুন্ড, ঐটা মৌলো ......।  মহা অষ্টমীর পুজো শেষে সন্ধিক্ষনে রাত দেড়টাতেও ঢাক বেজে উঠেছে গ্রামের নিস্তব্ধতাকে খান্ খান্ করে দিয়ে।  গ্রামের রীতি অনুযায়ী সেই ঢাক সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে সন্ধিক্ষনের পুজোর সময়  



 

                                    মহানবমীতে মজা ছিল সকালে ছোটদের স্পোর্টস এবং বিকেলে বিবাহিত ও অবিবাহিতদের মধ্যে ফুটবল খেলা। স্পোর্টসের মধ্যে সব চেয়ে মজা হত - চোখ বন্ধ অবস্থায় লাঠি দিয়ে হাঁড়ি ভাঙা ও যেমন খুশী তেমন সাজো। এর মাঝেই প্রতিদিন গ্রামের ক্লাব ঘরে বড়দের সাথে গিয়ে দেখে আসতাম আসন্ন থিয়েটারের মহড়া। নবমীর রাত্রে গ্রাম্য কায়দায় স্টেজ বানিয়ে হত থিয়েটার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্টেজ বানানোর জন্য নাড়ি বাড়ি ঘুরে জোগাড় করা হতো তক্তা, সতরঞ্জি, বড় চাদর, ত্রিপল ইত্যাদি।    


 

                               দেখতে দেখতে সারা বছরের প্রতীক্ষার দিনগুলো শেষ হয়ে চলে আসত দশমী। মন খারাপের দিন। আমরা সব থেকে ভাল পোষাকটা তুলে রাখতাম এই দিনের জন্য। সকাল থেকেই বিজয়াদশমীর মেলার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। বিকালে দুর্গা মন্দিরের মাঠে বসত নানা রকমারী দোকান-  আতস্বাজী পটকা, চুড়ি ,ফিতে,পাউডার,গলার মালা, ঘুঘনি, ডিমের ডেভিল, পাঁপড় ভাজা ইত্যাদিআমাদের প্রতিমাকে সারা গ্রাম প্রদক্ষিন করিয়ে একটা বড় আম গাছের তলায় রাখা হত। গাছের ডাল থেকে ঝুলে থাকা হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত হত মাঠ ও মায়ের মুখ। কেন জানিনা সেই আলোয় মায়ের মুখটা ভীষন মলিন লাগতো, হয়তো আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন তাই ।  প্রতিমার সামনে চলত লাঠিখেলা , লেঠেলদের আস্ফালন ও সাথে ঢাকের  দ্রিমি দ্রিমি বিদায়ী বোল মিলে গিয়ে কেমন এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হতো এরপর একটা সময় আসত যখন মাদুর্গাকে কাঁধে নিয়ে গ্রামের সবাই চলে যেত কুসকর্ণিকা নদীর দিকে, যেখান থেকে সপ্তমীর দিন আনা হয়েছিল মাকে চেয়ে দেখতে দেখতে হ্যাজাকের আলো ছোট বিন্দুর মতো হয়ে আসত। চোখে পড়ত শরতের পরিস্কার  আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ । মনটা এক অজানা ব্যথায় মুচড়ে উঠত।  চেষ্টা করেও আটকে রাখতে পারতাম না চোখের জল, গাল বেয়ে নেমে এসে ভিজিয়ে দিতো আমার সবচেয়ে ভালো জামাটা।

মন্তব্যসমূহ