আলেপ্পি - প্রাচ্যের ভেনিস - Alappuzha ( former Alleppey ) of Kerala - is called Venice of the East
গোটা শহরটাই জলের নাগপাশে বন্দী। আরব সাগর, ভেম্বানাদ হ্রদ, পুন্নামাডা হ্রদ এই শহরটাকে ঘিরে আছে। আর অসংখ্য খাল, খাঁড়িপথ জাল বিস্তার করে আছে গোটা শহরটাকে। আর এই জলেই লুকিয়ে রয়েছে আলেপ্পির আসল সৌন্দর্য। তাই আলেপ্পিকে ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ বলা হয়। আলেপ্পির বর্তমান নাম আলাপ্পুঝা। ‘আলা’ শব্দের অর্থ খালবিল ও ‘পুঝা’ শব্দের অর্থ নদী। গোটা শহরটাতে মায়াজাল পেতে রেখেছে ‘ব্যাকওয়াটার’। আর এই বিখ্যাত ব্যাকওয়াটারের সৌন্দর্যের টানেই সারা পৃথিবী থেকে ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ছুটে আসেন। আমরাও সেই টানেই আজ এখানে।
এই ব্যাকওয়াটারে ভেসে থাকার মজাটাই আলাদা। তবে কিভাবে মজা নেবেন সেটা আপনার উপরেই নির্ভর করবে। হাতে সময় থাকলে একরকম, অন্যদিকে সময় কম থাকলে অন্যরকম। যদি অধিক জলবিহার ভাল লাগে তাহলে আলেপ্পি থেকে কুইলন ( কোল্লাম ) আট ঘন্টার নৌকাবিহারে ভেসে পড়তেই পারেন জলে। দীর্ঘ এই জলপথে ব্যাকওয়াটারের সব সৌন্দর্যই উপভোগ করা যাবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গ্রাম্যজীবন, জেলেদের সংগ্রাম, মাছধরার কৌশল, বিস্তীর্ণ জলরাশির চোখজুড়ানো সৌন্দর্য, গ্রাম্য পরিবেশে দুপুরের ভোজন – সবটাই পাওয়া যাবে এই যাত্রাতে। তবে এতটা সময় দিতে না পারলে বা এতটা জলযাত্রা ভাল না লাগলে ঘন্টা দুয়েকের জন্য ভেসে পড়তেই পারেন ব্যাকওয়াটারের জলে। সেক্ষেত্রেও পাওনা কিছু কম হবে না।
আমাদের হাতে সময় বেশী না থাকাতে আমরা এই দ্বিতীয়টাকেই বেছে নিলাম। টিকিট কেটে লঞ্চে চেপে বসলাম। আপার ও লোয়ার – দুটি জায়গাটাতেই বসার ব্যবস্থা আছে। খালের মত একটা জলা জায়গা থেকে আমাদের লঞ্চ ছাড়ল। এই জায়গার জল একটু নোংরা, তবে যতই এগোতে থাকি ততই জলপথ চওড়া ও পরিস্কার হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে আমাদের চোখের সামনে হতে লাগল পট পরিবর্তন। আলেপ্পি শহর, তার বড় বড় রেস্তোরা, লজ, হোটেল পার হয়ে প্রবেশ করলাম গ্রামীণ জীবনের মধ্যে। কোথাও গাছ নুয়ে পড়ে জলের স্পর্শ পেতে চায়, কোথাও আবার শিকারী মাছরাঙা ঝুপ করে জল থেকে শিকার তুলে আহার সারে। দুপাশের নারকেল বন ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় ব্যাকওয়াটারের জলরাশি। ডাঙ্গার ধারে ধারে অগুন্তি নৌকা, লঞ্চ ও হাউসবোট সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে। জলপথে মাঝে মাঝে আমাদের সাথে দেখা হচ্ছে অন্য পর্যটন লঞ্চের। এরই মধ্যে সাধারণ যাত্রীবাহী লঞ্চ কর্মজীবনে ব্যস্ত মানুষদের নিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। জলের ধারে সারি সারি রকমারি হাউসবোট আমাদের মন ভরিয়ে দিয়ে চলেছে। কি সুন্দর তাদের গঠনশৈলী ! এই হাউসবোটগুলোর স্থানীয় নাম ‘কেট্টুভাল্লাম’। আরো এগিয়ে যেতেই চারদিকে শুধুই জল আর জল, আদি অনন্ত জলরাশির মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপ। আমরা নামলাম সেখানে। এখানে ডাবের শীতল জল ও গরম চা – এই দুই ব্যবস্থাই আছে গলা ভেজাবার জন্য। দেখতে দেখতে একঘন্টা কেটে গেল। এবার ফেরার পালা। জলপথের বাম দিক দিয়ে এগিয়ে এসে এবার ডানদিক দিয়ে ফেরা। প্রাচ্যের ভেনিসের মনোরম কিছু দৃশ্য স্মৃতির পাতায় থেকে গেল।
তবে ব্যাকওয়াটারের আসল রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে হাউসবোটে রাত কাটানোর মধ্য দিয়ে। কি নেই হাউসবোটে ? থাকবার ঘর, ডাইনিং হল, ব্যালকনি, বাথরুম সব কিছুই। চাইলে এসি চালাবার ব্যবস্থাও আছে। নরম গদীতে বসে ব্যাকওয়াটারের সৌন্দর্যে মজে গিয়ে মনের খিদে মেটানোর সাথে সাথে নিজের পছন্দের দক্ষিণ ভারতীয় পদের স্বাদও নিতে পারেন। আলেপ্পির ব্যাকওয়াটারে হাজারখানেক হাউসবোট আছে। জালের মত বিছানো জলপথে চলাচল করে শয়ে শয়ে নৌকা, লঞ্চ, অন্যান্য জলযান। সত্যিই আলেপ্পিকে ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ বললে বাড়িয়ে বলা হবে এতটুকুও। দিনের বেলা হাউসবোট ধীরে ধীরে আপনাকে নিয়ে ব্যাকওয়াটারের মনমুগ্ধকর দৃশ্য উপহার দিয়ে যাবে। সরু খাঁড়ি থেকে সুবিশাল জলাশয়ের মাঝে পৌঁছে সূর্যাস্তের অসাধারণ শোভা দেখিয়ে আবার ফেরত নিয়ে আসবে নিজের জায়গায়। জলে ভেসে থেকে রুমের গদি বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে তখন মনে হবে সত্যিই এটা ভগবানের আপন দেশ ।
থাকার জায়গাঃ রাত্রিবাসের জন্য কেরল ট্যুরিজমের সাইটে ক্লিক করুন
কিভাবে যাবেনঃ কলকাতাসহ ভারতের সব জায়গা থেকেই ট্রেনে বা ফ্লাইটে তিরুবনন্তপুরম (ত্রিবান্দ্রম) চলে আসা যায়। সেখান থেকে আলেপ্পি বা আলাপ্পুঝা বাসে বা গাড়িতে যাওয়া যাবে। দূরত্ব প্রায় ১৪৮ কিলোমিটার ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন