শীতের মজা বাউল মেলাতে - JOYDEV KENDULI MELA also known as BAUL MELA

 

                       

RADHABINOD TEMPLE, JOYDEV KENDULI, INDIA

             মুখে মাস্ক, মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। বর্তমান সময়ে এই জীবন যাপন আমরা মেনে নিয়েছি। তারপরে আবার Omicron variant এর ভয়। তাই শীতের রাতে বাউল মেলা ঘোরা যেন দিবাস্বপ্ন। শুধুনাত্র স্বপ্নই কারণ সব ধরনের মেলাই তো গত দুবছর ধরে বন্ধ। তাই এবার মেলা হোক বা না হোক, ঘুরতে পারি বা না পারি,  আরো একবার সোনালী দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে বাঁধা কোথায়? তাই টাইম মেশিনে করে ফিরে যাচ্ছি বছর খানেক আগেকার দেখা জয়দেব কেন্দুলির বাউল মেলার মাঠে।   

               হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় সারারাত মেলা দেখার মজাই আলাদা। হ্যাঁ, আমি রাতের কথাই বলছি, দিনের মেলার মজা তো আছেই। রাতের মেলার রূপ, রস, স্বাদ ভিন্ন। দিনে মিঠে রোদে উত্তুরে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মেলা দেখার মজা একরকম। আবার সেই মেলাতেই রাতভর বাউল আখড়ায় খড়ের গদিতে চাদরমুড়ি দিয়ে বসে বাউল ও কীর্তনে মজে যাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। এই আনন্দ অনুভূতির স্বাদ নিতেই বছর খানেক আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম জয়দেব কেন্দুলির মেলায়। এত বড় ও এত প্রাচীন গ্রাম্য মেলার তুলনা মেলা ভার। এই মেলা বাউল মেলা হিসাবেও বিখ্যাত।  

                           বীরভূম ও বর্ধমান জেলার সীমানা রক্ষা করে বয়ে চলেছে অজয় নদী। সেই নদীর উত্তর তীরে বীরভূমের জয়দেব কেন্দুলির ইতিহাস সুপ্রাচীন। এই জায়গার বিশেষ পরিচিতি গীতগোবিন্দের রচয়িতা ও লক্ষ্ণণ সেনের সভাকবি জয়দেবের জন্মস্থান হিসাবে। তাই শুধুমাত্র মেলার টানেই নয়, ইতিহাস প্রসিদ্ধ পর্যটন কেন্দ্র হিসাবেও সবসময় জয়দেব কেন্দুলিতে আসা যায়।  

                            পৌষমাসের মকর সংক্রান্তির দিনে মেলা বসে। এর পিছনেও একটা ইতিহাস আছে। কবি জয়দেব নিত্য গঙ্গা স্নানে যেতেন। কিন্তু মকর সংক্রান্তির পূণ্যলগ্নে গঙ্গায় না যেতে পারার জন্য কবি মনের দুঃখে রয়েছেন সেই সময় মা গঙ্গা কবিকে স্বপ্ন দেন যে তিনি মকর সংক্রান্তিতে হাজির হবেন কদম্বখন্ডির ঘাটে। উজানে জলধারা বইছে দেখে বোঝা যাবে যে তিনি এসেছেন। সেই সময় থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ পবিত্র লগ্নে গঙ্গাস্নানের পূণ্য লাভের আশায় জয়দেবের কদম্বখন্ডির ঘাটে স্নান শুরু করেন। বীরভূম জেলা প্রশাসনের তরফে মেলা পরিচালন কমিটি সরকারীভাবে তিনদিনের মেলা করলেও ভাঙা মেলা থেকে যায় এক সপ্তাহের বেশী। 

                               

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
জয়দেব মেলাতে কেনাবেচা চলছে

 

               পানাগড় মোড়গ্রাম সড়ক পথে এসে জয়দেব মোড় দিয়ে বেশ খানিকটা ঢুকতে হল। মেলায় প্রবেশের আগে মাঠের মধ্যে একটা বিশাল পার্কিং জোন। সেখানে বাস, বড় গাড়ি, ছোট গাড়ি মিলিয়ে কয়েকশ গাড়ি পার্কিং করা আছে। জন সমুদ্রের দেখা মিলল মোড় থেকেই। মেলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেটা জন মহাসাগরের রূপ পেয়ে গেল। এখানে মেলা বসার জন্য বিশেষ কোন মাঠ বা জায়গা নেই। গোটা গ্রাম জুড়েই মেলা বসে। মেলার দোকান গ্রামের রাস্তার দুইপাশ ছাড়িয়ে পাশের ধান মাঠেরও দখল নিয়ে নিয়েছে। 

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
মাছের জাল এভাবেই বিক্রী হয় মেলাতে

 

                     লাঠি, কম্বল, কাঠের পুতুল, বাঁশি, পাথর বাটি, শিলনোড়া, লোহার জিনিষপত্র যেমন বিশাল কড়াই, ঝাঁঝড়ি, হাতা, মাছ ধরার জাল কি নেই মেলাতে। আক্ষরিক অর্থেই সংসারের দৈনন্দিন ব্যবহারের সব জিনিষই এখানে পাওয়া যাচ্ছে। সত্যিই এটা  প্রকৃত গ্রাম্য মেলা।

 

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
শিলনোড়াসহ পাথরের যাবতীয় জিনিষপত্র

                  রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। নানা দোকান থেকে ক্রেতাদের ডাকাডাকি চলছে। পাশাপাশি চলছে দোকানদার ও খদ্দেরদের মধ্যে দরকষাকষি। এবার রাস্তা থেকে পাশের মাঠের দিকে নেমে মেলার ভিতর দিকে চলে এলাম। সামনেই বিরাট নাগোরদোলা, তার টিকিটঘরের সামনে বাচ্চাদের ভীড় বেশী। আশেপাশে চলছে চোখ বন্ধ করে বাইক চালানো, ম্যাজিক শো। 

 

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
 নাগোরদোলা চাপার সুযোগ এই মেলাতেই পাওয়া যায়

                  এছাড়া বাউল ও কীর্তনীয়াদের আখড়া। এগুলিই বাউল, কীর্তনীয়াদের অস্থায়ী থাকার জায়গা। কোথাও আসর চলছে, কোথাও আবার চলছে সারারাতের জন্য প্রস্তুতি। কোথাও আবার যুবতী কীর্তনীয়ার কীর্তনে মজে আছেন সমবেত দর্শকের দল। শীতের কামড় থেকে রক্ষা পেতে সব আখড়াতেই খড় বিছিয়ে গদি বানিয়ে তার উপর সতরঞ্জি দিয়ে ঢাকা।

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
 এইভাবেই জমে ওঠে কীর্তনের আখড়া

 

                     ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেলে খিদে মেটানোর জন্য পাওয়া যাচ্ছে জিলিপি, রকমারী মিষ্টি, এগরোল, মোগলাই, চা, কফি।  তবে ঘুরতে ঘুরতে অনুভব করলাম বিশ্বায়নের কুপ্রভাব প্রাচীন এই গ্রাম্য মেলার ঐতিহ্যতেও থাবা বসিয়েছে। তার প্রমান আধুনিক মিউজিক সিস্টেমে মাইক্রো চিপে ভরা হিন্দীমুভির গান চারিদিক মুখরিত করে রেখেছে। একটু একটু করে ভীড় ঠেলে এগিয়েই চলেছি। সামনেই পেলাম মেলা কমিটির অফিস। কমিটির দায়িত্বে থাকা মানুষজন নানান নির্দেশ দিয়ে চলেছেন। তার মাঝেই অনুসন্ধান বিভাগের ঘোষনা – মা বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ছোট বাচ্চাকে তাদের অফিস থেকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ।    

 

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
চোখ বেঁধে মোটর সাইকেল চালানোর খেলা, গায়ে কাঁটা দেয়
Joydev kenduli fair, Birbhum, India
মেলার এক টুকরো ছবি


                          এর পরেই পৌঁছে গেলাম জয়দেব কেন্দুলির বিখ্যাত রাধাবিনোদের নয়চূড়ো নবরত্ন মন্দির, গায়ে টেরাকোটার কাজ। বাইরে ভিতরে দর্শকের ভীড়। দর্শনের জন্য লম্বা লাইন রয়েছে। বাইরে থেকে কিছু ছবি তুললাম। এরপর আরো একটু এগোতেই দেখা মিলল অজয় নদীর। তার বাঁধ থেকে দাঁড়িয়ে সামনের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। নদীতে এখন জল প্রায় নেই বললেই চলে। নদীর বালিতেই মেলা বসেছে। জানলাম আগে নাকি অজয় নদীর বালিতেই মেলা বসত। সময়ের সাথে সাথে মেলার কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। মেলাও ছড়িয়ে পড়েছে সারা গ্রাম। 

 

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
গ্রাম ছাড়িয়ে অজয় নদীর বালিতেও মেলা বসে

                            সারা দুপুর মিঠে রোদ লাগিয়ে মেলা দেখার পরে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ল। তখনও দলে দলে মানুষ বাস , গাড়ী বোঝাই করে মেলাতে প্রবেশ করছেন। সন্ধ্যের পরে মেলার বাইরের ভীড় কিছুটা কমে গিয়ে ভীড় জমে ওঠে বাউল ও কীর্তনীয়াদের আখড়াগুলোতে। রাত বাড়তে লাগল, জমে উঠছে বাউল, কীর্তন। গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাউল , কীর্তনে মজে গেলাম। পার হয়ে গেল লম্বা শীতের রাত। 

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
জমে উঠেছে কীর্তন

 

                            জয়দেব মেলার আকর্ষণ এমনই যে সারারাত এখানে মানুষ আসছেন সিউড়ী, ইলামবাজার, বোলপুর, দুর্গাপুর হয়ে সারা বাংলা থেকে। সারারাতের জমজমাট মেলাতে বাউল, কীর্তনের আখড়াতে থাকার অভিজ্ঞতা সারাজীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে। বর্তমান করোনা আবহে লক্ষ লক্ষ মানুষের এই মিলন মেলার কথা খুব বেশী করে মনে পড়ছে। 

 

Joydev kenduli fair, Birbhum, India
রাধাবিনোদ মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কারুকার্য

মেলা ছাড়াও অন্যান্য আকর্ষণঃ টেরাকোটার কারুকার্যে সমৃদ্ধ নয়চূড়ো রাধাবিনোদ মন্দির। এই মন্দিরের অষ্টধাতুর রাধা ও কালো পাথরের কৃষ্ণের যুগল আজও সমান আকর্ষণীয়। এছাড়া কুশেশ্বর শিব মন্দির, অষ্টাদল পদ্মাসন, কদমখন্ডির ঘাট, রাধাবল্লভ মন্দির ও বিশ্বমঙ্গল মন্দির বিখ্যাত। জয়দেব কেন্দুলির প্রাচীনতম দেবতা কুশেশ্বর শিব। এই শিবের পূজারী ছিলেন কবি জয়দেব।

 কিভাবে আসবেন জয়দেব কেন্দুলির মেলায়ঃ কলকাতা থেকে ট্রেনে এলে বোলপুর বা দুর্গাপুরে নামতে হবে। সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে জয়দেব মেলা। বাসে এলে পানাগড়- মোড়গ্রাম হাইওয়ে ধরে এসে জয়দেব মোড়ে নামতে হবে। সেখান থেকে মেলাতে পৌঁছাতে আরো কিছুটা পথ যেতে হবে। মেলার সময় বোলপুর, দুর্গাপুর, সিউড়ি থেকে মেলা স্পেশাল বাস আসে এখানে। 

সিউড়ি থেকে জয়দেব কেন্দুলির দূরত্ব ৪০ কিমি

বোলপুর থেকে জয়দেব কেন্দুলির দূরত্ব ৩০ কিমি

দুর্গাপুর থেকে জয়দেব কেন্দুলির দূরত্ব ২৫ কিমি


           

মন্তব্যসমূহ