বনবাসের অস্থায়ী ঠিকানা - Neora Jungle Camp - a cheering sight to visit
ডিসেম্বর ২০২০ এর প্রথম সপ্তাহ, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই দার্জিলিং মেলে ( স্পেশাল ট্রেন হিসাবে চলছিল ) চেপে বসলাম পুত্র ও আমি ভিড় এড়াবার জন্য এসি ফার্ষ্ট ক্লাসে দুজনের ক্যুপে। সারারাত বেড়ানোর উত্তেজনাতে ঠিকমত ঘুমই হল না। সকালবেলায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছালাম। বাইরে আসতেই দেখি আমাদের ড্রাইভারসাহেব গোপালদা গাড়ি নিয়ে আগেই হাজির। আমরা প্রথমে জলপাইগুড়িতে আমাদের অফিসের গেস্ট হাউসে এলাম। সেখানে হাত মুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে দুপুরের দিকে চললাম গরুমারা জঙ্গলের দিকে।
খানিকটা যেতেই রাস্তার সৌন্দর্যে মন ভরে গেল। দুদিকে জঙ্গল ও মাঝখান দিয়ে কালো মসৃন রাস্তা। নেওড়া মোড় আসতেই আমরা থামলাম, গোপালদা বললেন – এখানেই খেয়ে নিন। আমরাও সেখানেই দুপুরের খাওয়া সারলাম। আমাদের আসার পরিকল্পনা হঠাৎ করেই, তাই থাকবার জন্য কোন বুকিং নেই। লাটাগুড়িতে রাস্তার উপরে প্রচুর রিসর্ট, লজ আছে কিন্তু আমরা থাকতে চাই জঙ্গলের ভিতরে। তাই কাছেই বনদপ্তরের অফিসে গেলাম। সেখানে জানলাম নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্পে থাকার বুকিং সব অনলাইনেই হয়। তবে চারটে রুম আছে যেটা স্পট বুকিং করা হয়, কিন্তু বাথরুম এটাচ নয়। আমরা তাতেই রাজি হলাম। ভাড়া দৈনিক আটশো টাকা। দুদিনের জন্য বুকিং করলাম। টাকা মিটিয়ে রসিদ নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এই রশিদটা জঙ্গল ক্যাম্পের কেয়ারটেকারকে দেখাতে হবে।
![]() |
| বুকিং এর রসিদ, যেটা আমাদের পরে দেখাতে হল |
![]() |
| |
আমাদের গাড়ি আবার ছুটল। কিছুদূর মূল রাস্তা দিয়ে যাবার পরে বাঁদিকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। গেটের মাথায় লেখা ‘নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্প’। এরপরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা। রাস্তা না বলে মেঠো পথ বলাই ভাল। পথের দুপাশে জঙ্গল, মাঝে যাওয়া আসার জায়গা। পথ ঢেকে দেওয়া শুকনো পাতা চলমান জীপের হাওয়ায় পথের দুপাশে জড়ো হয়ে গেছে। মাঝে থেকে গেছে দুটো চাকার দাগ। পথের বাকী জায়গা ঘাস, ছোট পাথরে ভর্তি।
![]() |
| বনপথের দৃশ্য |
হঠাৎ গোপালদা আমাদের গাড়ি থামিয়ে দিল। আমরা তার মুখের দিকে তাকাতেই আমাদের সামনে দেখতে ইশারা করল। সামনে তাকিয়ে দেখি একটা ময়ূর রাস্তা আলো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বলা ভাল আমাদের পথ আটকে নিজের কাজ সারছে। সামনেই একটা সাঁকোর মত, তার তলা দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। সেই জলা জায়গাতেই খাবারের খোঁজে উনি এসেছেন। আমরা কয়েকটা ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। এরপরে বনের মধ্যে আরো খানিকটা গিয়ে যেতেই চোখে পড়ল আমাদের জঙ্গল ক্যাম্প।
![]() |
| আমাদের থাকবার জায়গা ও ওয়াচ টাওয়ার |
অপূর্ব সুন্দর জায়গা। চারদিক জঙ্গলে ঘেরা, মাঝে কয়েকটা কটেজ। অন্য দিকে একটা দোতলা বাড়ি, তার মাথায় ওয়াচ টাওয়ার। সেখানে গিয়ে একতলাতে বুকিং এর কাগজ দেখাতেই খাতায় সই সবুদ করিয়ে আমাদের থাকার ঘর দেখিয়ে দিল। ছোট্ট বাগান পার হয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেখানে একটা বারান্দা, বাঁ দিকে ওয়াচ টাওয়ারে ওঠার সিঁড়ি চলে গেছে। সামনে একটা বড় দরজা, সেখান দিয়ে ঢুকেই একটা সরু করিডর চলে গেছে। তার দুপাশে দুটো করে মোট চারটে ঘর। সবকটাই ফাঁকা, আমরা একটা ঘরে ঢুকে গেলাম। যথেষ্ঠ বড় ঘর, চারজনের থাকার ব্যবস্থা করা আছে। চারটে ঘরের জন্য দুটো বেশ বড় বাথরুম। কিন্তু বাস্তবে যেটা দাঁড়াল আমাদের দুটো মানুষের জন্য দুটো বাথরুম। ঘরগুলোর শেষে দুপাশে দুটো বাথরুম।ওয়াশ বেসিন, সামনে একটা আয়না, তাতে সাবান, অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্য রাখার জায়গাও আছে। ঠান্ডায় চান করার কথা মনে আসতেই গীজারটা চোখে পড়ল। আমাদের ঘরের নীচেই একতলাতে কিচেন। আমরা জিনিষপত্র রেখে নীচে নেমে এলাম। খাবারের ফুল প্যাকেজ চারশো টাকা, এই টাকাতেই সকালের চা, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, বিকেলের চা ও ডিনার।
![]() |
| আমাদের ডাইনিং হল |
বিকেল সন্ধ্যের মাঝামাঝি সময় হয়ে গেছে। অপরূপ সুন্দর লাগছে জঙ্গলকে। দূরে কিছু কটেজ, সামনে সাজানো গোছানো ডাইনিং হল। চারপাশে অরণ্যের শোভা উপভোগ করার জন্য বেশ কিছু বসার জায়গা। পিছনেই বিশাল বিশাল বৃক্ষ দিয়ে সাজানো জঙ্গল। সূর্যের আলো নিভে গেল, আকাশে শুধু আলোর রেশটুকু রয়ে গেছে। শয়ে শয়ে পাখি নিজের নিজের বাসায় ফেরত আসছে, তাদের বিচিত্র কলতানেই সেটা বেশ অনুভব করা যায়। মাঝে মাঝে কর্কশ আওয়াজ , বুঝলাম ময়ূর ডাকছে। দেখতে দেখতেই চারপাশের সবুজ কালচে হয়ে অন্ধকার নেমে এল। আমাদের ঘর, ডাইনিংএ আলো জ্বলে উঠল। এখানে নিজেদের গাড়ি বা মোটর বাইক এনে রাখা যাবে কিন্তু ড্রাইভার সাহেবের জন্য আলাদা করে থাকার ব্যবস্থা নেই। আমরা ফেরত চলে এলাম নিজের রুমে। আস্তে আস্তে ঠান্ডার কামড় বাড়তে লাগল, আমরা দুজন চুপ করে খাটে বসে আছি। কিছুক্ষনের মধ্যেই চা ও পকোরা এলো। জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভালই অনুভব করছি। মাঝে মাঝে তাকে খানখান করে দিয়ে জঙ্গলবাসীদের হুঙ্কার শুনতে পাচ্ছি। এখানে মোবাইলে কোন সিগন্যাল নেই। বাইরে এলে তাও একটু কথা বলা যাচ্ছে।
![]() |
| আমাদের ঘর থেকে রাতের দৃশ্য |
রাতের খাবারের ডাক নটার আগেই চলে এল। আমরা নীচে নেমে আমাদের ঘরের লাগোয়া বাগান পার হয়ে ডাইনিং হলে এলাম। যত সুন্দর ডাইনিং হল, ততটাই সুন্দর তার ব্যবস্থাপনা ও কর্মীদের ব্যবহার। অনেকগুলি সুন্দর টেবিল চেয়ার দিয়ে ডাইনিং সাজানো। আকৃতিতে খানিকটা গোলাকার, চারদিক জানলা দিয়ে ঘেরা। আমরা খেতে এসে দেখলাম আরো পাঁচজন টুরিষ্ট এই জঙ্গল ক্যাম্পে আছেন। ওনারা সম্ভবত অনলাইন বুকিং করে দূরের কটেজগুলিতে থাকছেন। লাওপালার ডিসে গরম ভাত, আলুভাজা, ফুলকফির তরকারী ও চিকেন দিয়ে গেল। শীতে জুবুথুবু হয়ে জঙ্গলের মাঝখানে বসে এই ডিনার স্বপ্নেও ভাবিনি।
লেপের তলায় শুয়ে ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে ময়ূরের ডাকে। জানলার কাচের মধ্য দিয়ে বাইরে তাকালাম। হালকা কুয়াশায় সদ্য জেগে ওঠা জঙ্গলের শোভা আমি প্রথমবার দেখলাম, চোখ জুড়িয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিলাম। নীচে নেমে প্রথমেই চা নিলাম। সকালের কুয়াশা ভেজা জঙ্গলের শোভা দেখব বলে খানিকটা এগোতেই কিচেন থেকে একজন বেশীদূর যেতে মানা করলেন। এখানে গাড়ি ছাড়া বনের মধ্যে যাওয়া মানা আছে। আমরা খানিকটা পথ এগোলাম। আমাদের পথের বাঁদিকে নেওড়া নদী বেশ খানিকটা দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সেখানে নাকি হাতির দল মাঝে মাঝে চান করতে আসে।
![]() |
| কুয়াশা ভেজা সকাল |
আমরা এবার পথ বদলে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নীচের দিকে নামতে লাগলাম। ইচ্ছে নদীর কাছাকাছি যাব। দেখলাম আমাদের পুরো জায়গাটা কাঁটা তার ও ইলেকট্রিক তার দিয়ে ঘেরা। কারণ জানলাম রাতে বন্য প্রাণীর হাত থেকে আবাসিকদের রক্ষা করার জন্য এই ব্যবস্থা।পাথুরে সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে নদীর দিকে।শেষ সীমানাতে পৌঁছে দেখলাম নদী আরো নীচ দিয়ে বইছে।যথেষ্ঠ চওড়া এই নদী নানা আকারের পাথরে ভর্তি। নদীর ধারে হাতির দেখা না পেলেও রকমারি প্রজাপতির দর্শন মিলল। চারদিক দেখেও মন যেন ভরে না।
![]() |
| পায়ে পায়ে নদী ঘোরা |
আলাপ হল এক পাখিপ্রেমীর সাথে, হাতে নিকনের হাই জুম ক্যামেরা। জানলাম পাখির ছবি তোলাটাই তার শখ। সেইজন্যই তার এখানে আসা। কয়েকদিন ধরেই সে ছবি তুলে যাচ্ছে। নদী থেকে ফিরে আমরা তিনজনেই সিঁড়ি বেয়ে ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় এলাম। ওয়াচ টাওয়ারটি আমাদের ঘরের উপরেই। সামনে দিয়ে সবুজ অরণ্যের সাথে মানানসই সিঁড়ি উঠে গেছে। ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় অনেকগুলি বসার চেয়ার। সময় কাটাবার ভাল ব্যবস্থা এখানে আছে। এখান থেকে চারপাশের সৌন্দর্য অন্যরকম। অনেক উঁচু থেকে জঙ্গলের চেহারা অন্য রকম। নানারকমের সবুজ বৃক্ষ, তাতে কোন কোনটাতে রঙ বেরঙের ফুল শোভা পাচ্ছে। দূরে একটা জলাশয়, তার চারপাশ গাছে ঘেরা। বেশ কিছু পাখি সেখানে ভীড় জমিয়েছে। আমাদের সাথে থাকা পাখিপ্রেমীর কাছ থেকে কয়েকটা পাখি চিনলাম। হঠাৎ দেখি সামনের গাছটায় এক ঝাঁক হর্ণবিল পাখি এসে হাজির হয়েছে। এখানকার গাছপালা এতটাই ঘন যে ভিতরের কিছুই দেখা যায় না।
| ওয়াচ টাওয়ার থেকে পাখি দেখা |
দুপুরের খাবারের পরে আবার অন্য দিকে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। এবার যে দিক থেকে আমরা এসেছি সেইদিকেই গেলাম। খানিকটা এগিয়ে রাস্তা বনের মধ্যে ঢুকে গেছে। প্রতি মুহূর্তে ভয় লাগছে হঠাৎ করে সামনে কিছু হাজির না হয়। তবে ভয়ের কিছু দেখা না পেলেও দুটি ময়ূরের কার্যকলাপ দেখতে দেখতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। হঠাৎ একজনের ইচ্ছা হল আমাদের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে অন্য দিকে যাবে। আমরাও থমকে দাঁড়ালাম। চুপকরে ক্যামেরা বন্দী করে গেলাম তার ঝলমলে সৌন্দর্য।
| পথ আগলে ময়ূর |
![]() |
| খাবারের খোঁজে |
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। ফেরার পথে আবিস্কার করলাম পাতাহীন এক গাছের ডগাতে বেশ কিছু টিয়াপাখির বাস। সন্ধ্যের মুখে যখন হাতির দেখা পেলাম না বলে মন খারাপ করছি, তখনই নদীর ধারে আবছা আলোয় দুই শাবককে নিয়ে মা হাতির দেখা পেলাম। আমাদের জঙ্গল ক্যাম্পে থাকা সার্থক হল। আবছা আলোয় পাখিদের সাথে আমরাও আমাদের রুমে চলে এলাম। আজকে আরো একবার উপভোগ করলাম অরণ্যের নিস্তব্ধতা। পরের দিন সকালে জঙ্গল ক্যাম্পকে বিদায় জানিয়ে আমরা চললাম ঝান্ডির পথে।
![]() |
| সন্ধ্যেবেলায় নিজের ঘরে ফেরা |
জঙ্গল সাফারিঃ নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্পে থেকে জীপ সাফারি করা যায়। বনের মধ্য দিয়ে সাফারি করিয়ে আবার এই জায়গাতে পৌঁছে দেবে। আবার এখান থেকে গরুমারা ফরেস্টের বিভিন্ন ওয়াচ টাওয়ারে যাওয়া যেতে পারে। গরুমারাতে গন্ডার, বাইসন, হাতি, চিতা, ময়ূর ও ১৯৩ রকমের পাখির দেখা পাওয়া যায়।
বেড়ানোর সেরা সময়ঃ নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি।
কিভাবে যাবেনঃ নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশন , শিলিগুড়ি বা বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি গাড়িতে আসাটাই সবচেয়ে ভাল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে লাটাগুড়ির দূরত্ব ৮৩ কিলোমিটার।
অনলাইন বুকিং - এখানে চারটে ডবল বেডের কটেজ আছে। সেগুলো সব এটাচ বাথ। রুম বুকিং করার জন্য এখানে ক্লিক করুন - অন লাইন বুকিং নেওড়া জঙ্গল ম্যাম্প










পড়তে পড়তে যেন ডুয়ার্সে হারিয়ে গেলাম ......
উত্তরমুছুন