আড্ডার একাল সেকাল

 

                      

                 এমন কোন বাঙালী নেই যিনি মান্না দে-র গাওয়া সেই চিরনতুন গান      কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই......’ , শোনেন নি। জনপ্রিয় সেই গানের মধ্যে দিয়ে ‘ কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ না থাকার আক্ষেপ ও যন্ত্রনা যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা আজও আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। সেটা হয়েছিল তার  কাছের বন্ধুদের অনুপস্থিতির কারণে। আসলে মনের মতো বন্ধু না থাকলে যেন আড্ডা জমতে চায় না। আজকের দিনে বসে গানটা শুনতে শুনতে আমরাও  নিজেদের হারিয়ে যাওয়া আড্ডাকে খুঁজতে শুরু করি। যদিও বাঙালীর নিজস্ব ঢং এর আড্ডাটাতে সেই সময়তেও  পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেনি। এরপর সময়ের সাথে সাথে আধুনিকতার চাদরে মুড়ে গিয়েছে গোটা  সমাজ। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে গিয়েছে আমাদের জীবনযাত্রা। শেষ দশকে টেলি কমিউনিকেশন-এর অভাবনীয়  উন্নতিতে আমরা সবাই হঠাৎ করে নিজেদের পালটে ফেলেছি। সময় এখন সবচেয়ে দামী। সবাই ব্যস্ত, ছুটছে সবাই।  তাই আড্ডা  মারবে কখন ? সময়-ই তো নেই।  কি ভাবছেন, আড্ডা মারা তাহলে একদম কমে গেছে তাই না ? কাউকে তো দেখাই যায় না রায়বাবুদের রকে, সাহাদের বারান্দায়। না, আপনার ভাবনাটা ভুল। আড্ডা মারা এখন আগের থেকে বেড়েছে, তবে বোঝা মুশকিল। আসলে ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা মারাটা দেখা যায় না । এটা অনুভব করতে হয়। আসলে সময়ের সাথে আড্ডা মারার স্টাইলেও এসেছে পরিবর্তন। বদলে যাচ্ছে  এর মূল বৈশিষ্ট। বর্তমানে ‘আড্ডা’ বিবর্তনের পথে। সবকিছুর মতো আড্ডাও  ডিজিটল হয়েছে। প্রথমে একটু পুরোন দিনের আড্ডার কথা বলে নি 

          ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখে এসেছি আড্ডার প্রাণবন্ত রূপ। আমি যে সময়ের কথা বলতে চাইছি সেই সময় স্মার্ট ফোন তো  দূরের জিনিষ, টিভি-এর পর্দার আকর্ষন সেভাবে সমাজে থাবা বসাতে পারেনি।  তাই হাতে সময় ছিল প্রচুর। প্রথমে আসি বাড়ির মেয়েদের আড্ডাতে। মা, কাকিমা, জ্যেঠিমা, দিদিদের দেখেছি বিকেল বেলায় পাড়ার অন্যান্য বাড়ির মেয়েদের সাথে গল্প জমাতে। আর শীতকালে মিঠে  রোদ গায়ে মেখে প্রত্যেক বাড়ির ছাদ বা বারান্দা থেকে জমে উঠত মহিলাদের আড্ডা। আর এই আড্ডা চলত ঘুঁটে কয়লার উনুনে রান্না সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে।   

                        একটা সময় ছিল যখন পুরনো আমলের বাড়িগুলোর সামনে একটা রক বা বারান্দা থাকতই। আর সেই রক বা বারান্দাই ছিল যুবকদের আড্ডা মারার জায়গা। যে সমস্ত যুবকদের আড্ডাস্থল ক্লাবঘর কেন্দ্রিক নয় , তাদের আড্ডার জায়গা রায়বাবুদের রকে বা মুখার্জীবাবুদের বারান্দাতে। আবার বাঙালীর আড্ডার অন্যতম হল এক কাপ চা। তাই সমীরের চায়ের দোকানের বাইরে রাখা চেয়ার ও বেঞ্চেও জমে উঠত জমজমাট আড্ডা। আসলে মাটির ভাড়ে চায়ে চুমুক না নিলে আড্ডার আমেজটাই যেন আসে না। চায়ে চুমুকের ফাঁকে ফাঁকেই চল গল্প, গান, কবিতা, সিনেমা, খেলা  নিয়ে তর্কাতর্কি। যদিও  আড্ডার কোন টপিক হয় না। আড্ডা যদি শুরু হয় শাহরুখের সিনেমা দিয়ে তো শেষ হয় ধোনীর খারাপ খেলা নিয়ে। আড্ডা মারার কোন সময়সীমাও নেই। এ নিয়ে বাড়িতে অনেককে কটু কথা শুনতে হয়। তবে একথা ঠিক যে প্রাণবন্ত আড্ডা বাড়িয়ে তুলত  সম্পর্কের গভীরতা, একতাবোধ, একসাথে পথ চলার শক্তি।      

             বয়স্কদের আড্ডা নিজের বাড়ির বারান্দাতেও দেখতে পাওয়া যায়। তবে শহরের দিকে বয়স্কদের দেখা যায় আপাত নিরিবিলি কোন পার্কের কোনায় আড্ডা জমাচ্ছেন। এনাদের আড্ডার বিষয় মূলত রাজনীতি, অসুখ বিসুখ, বর্তমান সমাজ, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি। তবে গ্রামের দিকে দুর্গামন্দির, শিবমন্দিরের মতো জায়গাতেই বয়স্করা জমায়েত হন।  

                   জীবনের চলার পথে কয়েকটা বছর কাটাবার সুযোগ হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। সমবয়সী বন্ধুদের সাথে একভাবে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার শিক্ষাও সেখানে পেয়েছি। সেইসব বন্ধুদের সাথে যখন আড্ডা জমে উঠতো তার মিষ্টতা ছিল অন্যরকম। কোন বন্ধুর ঘরে বাকীরা কাটিয়ে দিতাম ঘন্টার পর ঘন্টা।

          পড়াশোনা শেষ করে আমরা সবাই জীবন জীবিকার জন্য আর এক অন্য জগতে প্রবেশ করি। সেই সূত্রে আমরা যারা বাড়ির বাইরে মেস করে থেকেছি সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এইখানে থাকা মানুষগুলোর মধ্যেও এক সখ্যতা গড়ে ওঠে। সারাদিনের শেষে কর্মস্থল থেকে ফিরে আসার পর গল্প, রসিকতা, তাস খেলা, সিনেমা দেখা সবই চলে ভিন্ন বয়স ও ভিন্ন পেশার মানুষগুলির মধ্যে। জমজমাট হয়ে ওঠে মেসের আড্ডা। 

                                 টেলিকমিউনিকেশনের অভাবনীয় অগ্রগতির সাথে সাথে প্রথম দিকে প্রায় সকলের ঘরে ল্যান্ড ফোন ও পরে মোবাইল ফোনের প্রবেশ ঘটেছে। তখন থেকে অনেক প্রয়োজনই আমাদের মিটে যায় এদের মাধ্যমে। তাই অনেক কথাই আর আড্ডা বা ঠেকে বলার জন্য পড়ে থাকে না। হয়তো সামনা সামনি না হওয়ার সেই শুরু। এর পর কেবল টিভি, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট পরিষেবা নিজের আসনে আমাদের বেঁধে রেখেছে। আড্ডা দেওয়ার মানুষরাই এখন টিভি ও ইন্টারনেটের বিনোদনে মজে থাকেন। ইন্টারনেট ও উইনডোজ পিসি-র  মাধ্যমে আমরা যখন সমগ্র বিশ্বকে হাতের মুঠোয় করে ফেলতে শিখেছি তখনও  তা সকলের কাছে সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু  সমাজজীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটলো যখন বাজারে এলো স্মার্ট ফোন ও সাথে সুলভে ফোর জি পরিষেবা। তখন থেকেই আমাদেরকে  কোন এক অদৃশ্য মায়াজাল  প্রতিক্ষণে বেঁধে ফেলতে লাগল। অফুরন্ত কথা ও ভিডিও কল সামনা সামনি আড্ডার প্রয়োজনীয়তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে লাগল। অরকূটের পরে ফেসবুক, ট্যুইটার ইত্যাদি সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছি আমাদের বন্ধু, সহকর্মী , আত্মীয় স্বজন এমন কি হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথেও। এখানেও গ্রুপ, সার্কেলসহ এক বিশাল আড্ডাঘর। এটা হল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দেওয়া সবচেয়ে বড় আড্ডাঘর। এখানে যখন খুশী প্রবেশ করো , যখন খুশী চলে যাও। প্রথম দিকে এই পরিষেবা শুধুমাত্র ডেস্কটপ, ল্যাপটপ পিসি-তে সীমাবদ্ধ থাকলেও স্মার্ট ফোন ও ফোর জি পরিষেবার দৌলতে ডিজিটাল আড্ডাঘর সকলের হাতের মুঠোয়। বর্তমানে স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ২৪ ঘন্টাই আড্ডা। এরপর হোয়াটসঅ্যাপের মতো পরিষেবা এই আড্ডাকে অন্য মাত্রা দিয়ে দিয়েছে। রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে , স্টেশনে বাড়িতে সর্বত্র একই ছবি। শুধুমাত্র বর্তমান প্রজন্মই নয়, আমাদের সমাজের বিরাট অংশ মোহগ্রস্ত এই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে  চ্যাট তথা আড্ডা মারতে ।  

                                               এই কোলাহলহীন , নিঃশব্দ আড্ডা চলছে সর্বত্র, সবসময় এবং আমাদের সকলের চোখের সামনে। বাসে , ট্রেনে, গাড়ীতে লক্ষ্য করলেই দেখা যাচ্ছে যে আমাদের সহযাত্রীদের হাতের আঙুল চলছে মোবাইল ফোনের টাচস্ক্রীনে  এবং দৃষ্টি আটকে রয়েছে সেই স্ক্রীনের দিকে। সকলেই এক অদৃশ্য আড্ডাঘরে আড্ডা দিতে মগ্ন। পাশের মানুষটিও জানতে পারছেন না যে আড্ডা চলছে জোর কদমে।

                        এ যেন এক আবেগ , অনুভূতিহীন , কৃত্রিমতায় আবৃত এক আড্ডাঘর। শতশত বন্ধুর সাথে আমরা আড্ডা মারছি অথচ আমি একা , আমার পাশে কেউ নেই। ভার্চুয়াল জগতে বন্ধুর সংখ্যা যত বাড়ছে তত গাঢ হচ্ছে একাকিত্ব। পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো বন্ধু আজ দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে। অদৃশ্য মোহময়ী অন্তর্জাল প্রতিক্ষণে পরিবারের সদস্য ও বাস্তব জীবনের বন্ধুদের সাথে আমাদের বাঁধন আলগা করে দিচ্ছে। আড্ডার বিবর্তনের সাথে সাথে আমরা এগিয়ে চলেছি একাকিত্বের অন্ধকার জগতে।  

 

মন্তব্যসমূহ