ইটের সেলুন থেকে বিউটি পার্লার

 

             


                   
                          মাথার চুল নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথার শেষ নেই। চুলেই নাকি আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। সেটা সেই একদম ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। চুলকাটা খারাপ হলে সেলুনে চুলোচুলি পর্যন্ত হতে দেখা গিয়েছে। যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন তার চুলের বাহার ঠিক রাখার জন্য সেলুনও থাকবে। সেটা ইটে বসে গাছতলাই হোক বা আধুনিকতায় মোড়া বিউটি পার্লার হোক সব সেলুনের একটাই কাজ,  আমাদের চুলের স্টাইল বজায় রাখা।   

                  এবার আমার নিজের ও নিজের শহরের কিছু কথা বলি। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে প্রথমবার সেলুনে পা রাখি। তখনকার সেলুন বলতে “পটলের সেলুন” , “হাবলের সেলুন” যার আবার পোষাকি নাম ছিল “অপূর্ব সেলুন”। সেলুনে ঢুকেই একটা কাঠের চেয়ার, সামনে বড় আয়না, আয়নার সামনে একটা লম্বা কাঠের তাক, তাতে চুল কাটার যাবতীয় সরঞ্জাম – বড় কাঁচি, ছোট কাঁচি, একটা ক্ষুর, আর একটা চুল একদম কদম ফুলের মতো ছোট করার যন্ত্র, পাউডারের কোটদেওয়ালের কোনের দিকে থাকত একটা লম্বা চামড়ার বেল্ট। সেটাতে ক্ষুরটাকে ঘষে পালিশ করে ধার বাড়ানো হতো। আর সেলুনের সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল মোটামুটি খান আটেক ক্যালেন্ডার, তাতে কে নেই- দেবদেবী, দেশনায়ক, হিন্দী সিনেমা থেকে বাংলা সিনেমার হিরো ও হিরোইনরা। চুলকাটা শেষে পিছনটা কেমন হলো দেখাবার জন্য নাপিত কাকুরা একটা ছোট আয়না মাথার পিছন দিকে ধরত। সেটার মাধ্যমে সামনের বড় আয়নায় বুঝে নিতে হত, চুলটা কেমন কাটা হল। এইভাবে  কিছু সময় চলার পর বাবার কর্মক্ষত্রে বদলি হল। এরপর সেলুনে আমাদের নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা এড়াতে বাবা পটলকাকুর সাথে কথা বলে আমাদের দুইভাইয়ের বাড়িতে চুল কাটার ব্যবস্থা করলেন। শুরু হল আমাদের বাড়ির সেলুনে চুল কাটা। আমি চুলের স্টাইল নিয়ে কোনোদিন কোন কথা বলতে পারতাম না।  আমার ভাই পটলকাকুকে মাঝে মধ্যে চুল কাটার ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দিত পটলকাকু একদিন রেগে গিয়ে বলেই ফেললেন – তোমার ভাইয়ের চুল কাটার খুব হ্যাপা।   



                                এটা খুব সত্যি কথা প্রত্যেকেই তার সমসাময়িক কোন না কোন সিনেমার হিরো বা খেলার জগতের হিরোর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আমরা যখন ছোট আমাদের বড়দাকে দেখতাম কথা বলতে বলতে আয়নার খুব কাছে চলে আসত , তার পরেই চুলটা একটু ঠিক করে নিয়ে আমাদের কাছে জানতে চাইত যে তাকে ঠিক দেবানন্দের মতো দেখচ্ছে কিনা। এই সময়ে আমাদের এক পিসতুতো দাদাকে দেখেছি , মুখে কিছু না বললেও তার চুলের বিশেষ ছাঁট  সুপারস্টার রাজেশ খান্নার কথা মনে করিয়ে দিত। ছোটবেলায় হিপিদের নিয়ে কিছুই না জানলেও জেনেছিলাম যারা লম্বা লম্বা ঘাড় অবধি চুল রাখে তাদের “হিপিদের মতো চুল” রেখেছে বলা হতো। 


                              সময়ের সাথে সাথে উঁচু ক্লাশে চলে এলাম। সাথী বন্ধুদের চুলেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগল। কারো চুল বলিউডের সুপার স্টার অমিতাভ বচ্চনের আদলে তো কারো চুল ঝুলপি উধাও করে মিঠুনদার স্টাইলে। ততদিনে পটলকাকা, হাবলকাকাকে প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিয়ে আমাদের শহরের বুকে এসে গেছে নতুন নতুন সেলুন
ভাড়ি পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখা যেত একসাথে জনা ছয়েক মানুষের একসাথে চুল কাটার সুবন্দোবস্ত। আধুনিক ব্যবস্থা – ছয়টা রিভলবিং চেয়ার চার ধারে সাজানো, চারদিকের দেওয়াল আয়না দিয়ে মোড়া। চারদিকে আয়না থাকার সুবিধা হল -  পিছনের চুলের কাটিং দেখতে দেখতেই চুল কাটা। এছাড়া চুলে জল দেওয়ার জন্য স্প্রে মেশিন। সুগন্ধী পাউডার ও আফটার সেভের গন্ধে গোটা সেলুন মো মো করতওঃ! এর পরে চুল কেটে বের হবার সময় নিজের অজান্তেই সবাই  নিজেকে সুপারস্টার ভাবতে শুরু করল। আরো সময় পেরিয়ে ঝাঁ চকচকে সেলুনের একটা রেওয়াজ  শহরে চলে এলো।   

                            বাড়ির বাইরে পড়ার সময় হোস্টেলে দেখেছি আমার রুমমেটকে চুলের যত্ন নিতে সেমিস্টার পরীক্ষা চলার সময়তেও সে হাতে আর্ণিকা তেল নিয়ে মাথায় দিতে দিতে পড়ত পরবর্তীকালে চাকুরী সূত্রে মেসে থাকার সময় দু-একজন মেসমেটকেও দেখেছি সপ্তাহে একদিন স্নানের আগে সর্ষের খোল চুলে দিয়ে বসে থাকতে

                            তবে যেটা না বললে সেলুন দর্শন অপূর্ণ থেকে যাবে সেটা হল এখানকার আলোচনা। সেটা আরো ভালোভাবে শোনার ও  যোগদানের সুযোগ আসে সেলুনে ভিড় থাকলে। আমি আমার পাড়ার সেলুনে ২৬শে জানুয়ারী সকাল বেলায় চুল কাটতে গিয়ে দেখি ভিড় রয়েছে। আমার লাইন জনা কয়েকের পিছনে। অগত্যা  মন দিয়ে খবরের কাগজ মুখস্ত করতে লাগলাম।  তারই মাঝে আলোচনার কথা কানে আসে। সেখানে জানলাম কোহলীর সাফল্যের কারণ, ধোনীর এবার খেলা ছেড়ে দেওয়া  উচিত কিনা, লোকসভা নির্বাচনে দিল্লীর গদিতে কারা আসতে পারেন, কালো টাকা আসলে কিভাবে জমে ইত্যাদি। বসে থাকতে থাকতেই দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে একটা শোভাযাত্রা চলে গেল। হঠাৎ কানে এলো আচ্ছা – দাদা  ১৫ই আগষ্ট না হয় ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিল তা আজকে কি হয়েছিল জানা আছে ? একজন দাদা উত্তর করলেন এটাকে প্রজাতন্ত্র দিবস বলে।      

                                          সেলুনে গিয়ে ছেলেরা টিপটপ হয়ে ফিরবে, নিজেদের ফিল্মস্টার ভাববে আর এতে মেয়েদের হিংসা হবে না , তাই আবার হয় নাকি ? শুরু হয়ে গেল আমাদের শহরেও মেয়েদের চুল কাটা। গড়ে উঠল ছোট ছোট সেলুন থুরি “বিউটি পার্লার” । এখানে আবার মেয়েরাই নাপিত, ভাবতে বেশ মজা লাগল। এতদিন আমরা গ্রামে “নাপিত বৌ”কেই মেয়ে নাপিতের চোখে দেখতাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে মা, কাকিমা, জ্যেঠিমাদের নখ কেটে দিত, পায়ে আলতা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলত। যাইহোক প্রথম প্রথম মেয়েদের মধ্যে সংকোচ থাকলেও ধীরে ধীরে পার্লার যাওয়াটা অভ্যাস করে ফেলল। সেখানে শুধু চুল নয় মেয়েরা ছেলেদেরকে বহু ধাপ পিছনে ফেলে সুন্দরী হতে চাইলএরপর এখন আর অবশ্য পার্লারে যাবার দরকার পরে না, পার্লারের মেয়েরাই বাড়ি এসে সৌন্দর্যায়নের কাজ করে থাকে 


 
                                   চুলের স্টাইল নিয়ে আমাদের চোখে বলিউড, টলিউড স্টারদের ছবি ভসে উঠলেও  বাইরের মানুষদের চুলের স্টাইল নিয়ে আমরা জানতে পারি খেলা দেখার সময়
স্পোর্টস স্টারদের চুলের স্টাইল এখন সাধারণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে তবে একটা কথা না বললে অন্যায় হবে সেটা হচ্ছে আমাদের শহরের এক ক্লাবের কালীপুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রার গল্প বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল এই ক্লাবের সদস্যরা রকমারী চুলের সজ্জাতে নিজেদের সাজিয়ে তোলেন এই ক্লাবের বিসর্জনের শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ তারাই সমগ্র শহরবাসী যেমন এই দিনটাতে আনন্দ উপভোগ করেন তেমনি ক্লাব সদস্যরাও সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন এই দিনটির জন্য


 
                                              শুরুটা করেছিলাম ছেলেদের সেলুন দিয়ে, যেখানে চুল, দাড়ি, গোঁফ কাটা হয়। তবে এখন আর সেলুন নয়, মেয়েদের মতো ছেলেদেরও পার্লার। তবে সেখানে শুধু রকমারী চুল কাটা নয়, পাকা চুলকে কালো বা অন্য রঙে রাঙিয়ে দেওয়া, টাকে চুল বসিয়ে সুন্দর করার কাজও এখানে হচ্ছে। তবে নানা সময়ে নানা রকম চুলের ছাঁট হিট করলেও ন্যাড়া মাথার একটা আলাদা গুরুত্ব চিরকাল আছে। ন্যাড়া মাথা ভিলেন যেমন আমরা হিন্দী সিনেমাতে পেয়েছি তেমনি আবার গেরুয়া বসন পরে সৌম্য দর্শন সন্ন্যাসীকেও দেখেছি। বামুনদের তো একবার পৈতার সময় ন্যাড়া হতেই হয় তখন একবার ন্যাড়া মাথা ক্লিক করে গেলে আর দেখে কে ? মাথার চুল ভেজাল খেয়ে উঠে গেলে এর থেকে ভাল বিকল্প পাওয়া যাবে না এতদিন না ভেবে থাকলে এবার চুল কাটার স্টাইল নিয়ে ভাববার দিন এসেছে।  

মন্তব্যসমূহ