স্মার্ট ফেরিওয়ালা

 

                                 


      

                     গত দশ বারো বছরে কেনা বেচার পদ্ধতিতে এক বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে। তার আদব কায়দা শিখতেও আমাদের কয়েক বছর লেগে গেল। ভুলতে হলো কিছু বাংলা শব্দ, শিখতে হল কিছু বাংলা, সাথে কিছু ইংরাজী শব্দের নতুনরূপে ব্যবহার। ঠিক বোঝা গেল না তাই তো ? তাহলে পিছিয়ে যাই পঁচিশ, ত্রিশ বছর। আমরা যখন স্কুল পড়ুয়া ছিলাম তখন “ফেরিওয়ালা” শব্দটার সাথে খুব পরিচিত ছিলাম, যেটার আর সেই অর্থে ব্যবহার নেই। আমাদের মফস্বল শহরে তখন  হাতে গোনা কিছু ভাল দোকান ছিল, বাকিটা ছিল ফেরিওয়ালা নির্ভর। ফেরিওয়ালাদের কাজ ছিল তারা তাদের পসরা সাজিয়ে সেটা বাড়ি বাড়ি বিক্রী করতে যেতেন। মনে পরে তাদের সুরেলা ডাক, যার অভাব এখন অনুভব করি। এক শাড়ি বিক্রেতা আসতেন তার নিজস্ব ভঙ্গিমাতে ডাক দিয়ে ... “ইগারো হাত ছাপা শাড়ি সাড়ে বারো টাকা”। মা, কাকিমা ও আশেপাশের সবাই তার খদ্দের ছিলেন। পল্ট্রির ডিমের কথা আমরা তখন শুনিনি, কাজেই  মাথায় করে ডিম নিয়ে ফেরি করতেন যারা, তাদের ডাক ছিল “ডিম, ডিইইইম”। তাদের কাছে আলাদা করে জানতে হত না দেশী মুরগী বা হাঁসের ডিম আছে কিনা। আবার শীতকালে উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করলেই ধুমকেতুর মতো উদয় হোত বেশ কয়েকজন তাদের স্পেশাল ডাক নিয়ে ... “ খেজুরের গুড়, ঐ যে খেজুরের গুড়”আবার চৈত্রের ঝরঝরানি হাওয়া দিতে না দিতেই আনন্দের দিন আসতো আমাদের মতো ছোটদের, কারণটা হল সব ছোটদের প্রিয় আইসক্রীম ও কুলফি মালাই  এই সময়েই পাওয়া যেত। দুটো চাকাওয়ালা একটা ছোট গাড়ি, সেটা আইসক্রীমওয়ালারা ঠেলে ঠেলে নিয়ে ফেরি করত এর দুটো হ্যান্ডেল ধরে। “আইসসসক্রীম” বলে হাঁক দেবার সাথে সাথে বাক্সের ঢাকনাটা খুলে জোড়ে শব্দ করে বন্ধ করে দিত। আমাদের কাছে  সেই  কাঠি লাগানো সিরাপের আইসক্রীম বড়ই প্রিয় ছিল। কোন নামী আইসক্রীম তখন এখানে পাওয়া যেত না।  আবার খেজুর কেনার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হোত এক খেজুর বিক্রেতার কাছে , যিনি সুর তুলে পেরিয়ে যেতেন ........  “ পিন খেজুর, খেজুর” । কাজেই ফেরিওয়ালা  নির্ভর হয়েই কেটেছিল আমাদের ছোটবেলা। আর একটা কথা না বললে এই লেখা সম্পূর্ণতা পাবে না সেটা হল সিনেমা ফেরি করার কায়দা আমাদের শহরে মাত্র দুটো সিনেমা হল ছিল, শুক্রবার থেকে আসত নতুন সিনেমা ,সেটা একটা রিক্সা করে মাইকে জানাতে জানাতে যেতেন একজন ...... “ চৈতালির রূপালী পর্দায় আজ থেকে দেখবেন নাচে, গানে , ফাইটিং এ ভরপুর রঙীন হিন্দী ছবি .........”।      

                      এতো গেল আগেকার কথা। এরপর পার হয়ে গেছে বহু বছর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতিতে পালটে যেতে লাগল আমাদের সমাজ, গ্রাম শহরের বেড়া ভেঙে যেতে লাগল। শহর নগরের দূরত্বও কমে যেতে লাগল। আমরা ধীরে ধীরে রপ্ত করে নিলাম কেনা বেচার নতুন টেকনিক। থলে দুলিয়ে মুদির দোকানে ফর্দ দেওয়া; সবজি, মাছের বাজারে পাড়ার বোসবাবু, দাসবাবুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বাজার করার দিন শেষের মুখে। পাড়ার দোকানে অনেকে কেনাকেটার দাম মেটান মাসের শেষে, সেই ধারে কারবার লেখা থাকে চেনা দোকানদারের খাতায়। আজকের দিনে এইসব অবলুপ্তির পথে। এখন কেনাবেচার  জায়গা একছাতার তলায় – তার কেতাবি নাম শপিং মল। ঝা চকচকে আলো ঝলমলে বাজার, কিন্তু এখানে বিক্রেতা সেই অর্থে নেই। যারা দায়িত্বে থাকেন তারা ওয়েল ড্রেসেড তরুন, তরুনী।  জিনিষপত্র আপনাকে  নিজেকেই পছন্দ করে তুলে নিতে হবে। না, এখানে কোন নিজের থলে চলবে না, শপিং মলের ব্যাগ বা স্টীলের বাস্কেট দেওয়া ঠেলা গাড়িতে নিজেকেই তুলে নিয়ে যেতে হবে। বাজারের বিক্রেতাদের মুখে  “ ও দাদা, দিদি বা কাকু, কাকিমা” ডাক এখানে অমিল। সেরকম দরকারে  শুনতে পাবেন “ ইয়েস স্যার বা ম্যাম”। এরকম জায়গায় আপনার রোজকার বাজার করার পোষাক চলবে না বুঝতেই পারছেন। আপনাকে একটু কেতাদূরস্ত হতেই হবে। দাম মেটানোর সময় মন খারাপ করতে পারে পাড়ার দেবুর দোকানের ধারের খাতাটার জন্য ? বেশ সুন্দর সারা মাস কেনাকেটা করে মাস গেলে মিটিয়ে দিতেন দামমন খারাপ করবেন না, এখানেও ধারের ব্যবস্থা আছে। তবে ধারের খাতাটা খুলতে হবে কোন ব্যাঙ্কে। এখানে ধারে দাম মেটান ক্রেডিট কার্ডে, এছাড়া নগদ টাকা ও ডেবিট কার্ডতো আছেই। এই শপিং মলে কি নেই? বাড়িতে ব্যবহার করার সব জিনিষপত্র, প্রসাধনী দ্রব্য, মুদিখানার সব দ্রব্য, এখন ফলমূল, সবজি, মাছ, মাংস সব প্যাকেট করে পাওয়া যায়।   

                         কিন্তু আমাদের  কাজের কোনও শেষ নেই, তাই ব্যস্ততারও কোন সীমা নেই। তাই এক ছাতারতলাওয়ালা  শপিং মলে যাবার সময়ও পাওয়া যাচ্ছে না। আর এই  দূর্বলতার সুযোগেই এখনকার “ফেরিওয়ালা”রা এক্কেবারে হাজির হলো আমাদের বেডরুমে। চালু হয়ে গেল “অনলাইন পরিষেবা”। না, কোনো সুরেলা ডাক নেই এখানে, চুপিচুপি আমাদের মনের গোপন কথা জেনে নিয়ে তারা হাজির আমাদের ফোনের স্ক্রীনে। রাত্রে দিনে চব্বিশ ঘণ্টাই দোকান খোলা, নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেলফোনে পছন্দ করুন আপনার প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র, কদিনের মধ্যেই  আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে সেইসব জিনিষপত্র। আক্ষরিক অর্থেই হীরে থেকে জিরে সবই পাবেন “অনলাইনে”। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে আসবাবপত্র, টিভি, ফ্রীজ, এসি মেসিন, ওষুধপত্র , জুয়েলারী সবকিছুই পেয়ে যাবেন সেল ফোনের টাচ স্ক্রীনে আঙুল ছোঁয়ালেই এই পরিষেবার জন্য সব সময় আপনার ফোনে হাজির ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন, স্ন্যাপডিল ইত্যাদি। এতেও মন ভরল না ? প্রতিদিন খাবার রান্না করে খেতে ইচ্ছা হয় না ? বাইরের খাবার খেতে ইচ্ছা করছে ? তার ব্যবস্থাও অনলাইনেএখন স্যুয়গী, জোম্যাটো ...... ইত্যাদি সংস্থার মাধ্যমে যে কোন বিখ্যাত রেস্তোরার খাবার ঘরে বসেই পাওয়া যায়। তাই সেল ফোনের স্মার্ট হওয়ার পাশাপাশি  আমাদেরকেও হতে হবে স্মার্ট, শিখতে হবে স্মার্টফোনের ব্যবহার। “ ফেরিওয়ালা”  যখন  নিজেকে বদলে স্মার্ট হয়েছে তখন আমাদের তো হতেই হবে , তাই না?     


মন্তব্যসমূহ