আভিজাত্যের ঝর্ণা কলম- Aristocracy hidden in fountain pen

 


                                 

                        ঝর্ণা কলমবা ফাউন্টেন পেননামটা শুনলেই  ঘড়িটা যেন হঠাৎ করে দ্রুত উল্টো দিকে ঘুরে কয়েক দশক পিছনে  নিয়ে চলে যায় আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত হারিয়ে যাওয়া ছবি হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া এক ঝর্ণা কলম আমাকে স্মৃতির পাতা উল্টে দেখতে বাধ্য করল স্কুল জীবনে প্রথম কয়েক বছর পেন্সিল, রাবার দিয়ে লেখাপড়া করার পরে তো দীর্ঘ দিনের সাথী ছিল ঝর্ণা কলম খুব ছোটতে দেখেছিলাম আমাদের বাড়িতে একটা কলম রাখার জায়গা ছিল যাতে রাখা থাকত দুটো কলম সেগুলো অবশ্য ব্যবহার হত না কাঠের তৈরী কলম দুটোতে কোন কালি ভরার জায়গা ছিল না, শুধুমাত্র একটা স্টীলের নিব লাগানো ছিল দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম মায়ের কাছে শুনেছিলাম আগে নাকি এমন কলমই ছিল  


 

                এটা দিয়ে লিখতে গেলে পাশে কালির দোয়াত রাখতে হত কলমটিকে কালিতে একবার ডুবিয়ে নিয়ে লিখতে হত কালি শেষ হয়ে গেলে সেটিকে আবার দোয়াতে ডুবিয়ে নিতে হত এভাবেই চলত লেখালেখি তবে এর সুবিধা ছিল বার বার কলমের নিবকে চেঁছে তীক্ষ্ণ করতে হত না এর আগে সমস্যাটা আরো বেশী ছিল প্রথম দিকে পাখির পালকের নীচের দিকে চেঁছে তীক্ষ্ণ করে লেখালেখি চালানো হত একে বলা হতকুইল পেন এটা ব্যবহারের প্রধান অসুবিধা কলমের নিব তীক্ষ্ণ করা দোয়াত থেকে বারে বারে কালি নেওয়া     


 


                                   দোয়াত থেকে কালি নেবার অসুবিধা দূর করতে ১৮৮৪ সালে বাণিজ্যিক ভাবে আসে ঝর্ণা কলম, তাতে কলমেই কালি ভরে নেবার ব্যবস্থা ছিল সেই কালি ঝর্ণার মত কলমের নিবে নেমে আসত তবে বাণিজ্যিকভাবে পরের দিকে এলেও প্রথম আবিস্কার মিশরে সম্ভবত ৯৫৩ সালে এই কলমের একটা ঢাকনা,  সামনে সোনালী বা রূপালী রঙের মেটাল নিব, তার তলায় থাকত ছোট্ট ছাঁচের মত কলমের নিবে প্রথম দিক থেকে সামান্য কাটা থাকত, তারপরে থাকত একটা গোল ছিদ্র কলমের পেটে থাকত কালি ভরার ব্যবস্থা এই কালি ভরার জন্য রাখতে হত ড্রপার, সেটাতে করে কালির দোয়াত থেকে কালি উঠিয়ে কলমের পেটে ফোটা ফোটা করে ঢেলে দিতে হত ছাত্রজীবনে একসময় আমরা কালি ভরাতে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলাম তখন আর ড্রপার লাগত না কালির দোয়াত উঠিয়ে সরাসরি পেনের পেটে ঢেলে দেবার দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছিলাম এই দক্ষতা অর্জনের পথে প্রথম দিকে কলম ছাপিয়ে কালি পড়ে ঘরের মেঝে নীল, লাল হয়ে উঠত তার জন্য মায়ের কাছে বকুনি খাওয়ার  অভিজ্ঞতা আশাকরি আমার মত অনেকেরই আছে তবে কিছু কলমের মধ্যেই ড্রপারের মত ব্যবস্থা থাকায় তার মধ্যেই কালি জমা থেকে যেত তবে এই ধরনের কলমে কালি ভরাটা সহজ হলেও ধারন ক্ষমতা ছিল কম, এতে কালি কম ধরত এই কলমগুলি সবই ছিল ‘WING SUNG’ কোম্পানীর তৈরী হত চীনে      

                    পরীক্ষার সময় হলে আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যেত কলমের সমস্ত অংশ খুলে জলে ভাল করে ধুয়ে  আবার কালি ভরে পরীক্ষার জন্য রেডি করে রাখতাম নতুন কলম কিনে এনে প্রথম কদিন লিখতে বেশ অসুবিধা হত সেটা দিয়ে অনেক লিখে লিখে কলমের নিবকে নিজের লেখার মত করে নিতে হত আমরা  পরীক্ষার সময়তে দুটো করে কলম নিয়ে যেতাম অনেককে কালির দোয়াত সাথে নিয়ে যেতেও দেখেছি কালি কলমের সম্পর্ক ছিল মধুর সেই সময় আমরাসুলেখাকালি ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত ছিলাম নীল লাল এই দুই রকম কালির ব্যবহারই বেশী প্রচলিত ছিল সেই সময়ডট পেনবাবল পয়েন্ট পেনখুব একটা ভাল মানের পাওয়া যেত না পাওয়া গেলেও তা ছিল আমাদের মত সাধারণের নাগালের বাইরে এছাড়া আরো একটা ধারনা ছিল যে ডট পেনে লিখলে হাতের লেখা খারাপ হয়ে যাবে     

                                  সময়ের সাথে সাথে পেনের জগতে একটা বিল্পব এল হাতে এল উন্নত মানের ডট পেন, জেল পেন ধীরে ধীরে কালি কলম চোখের আড়ালে চলে গেল ডট পেনই হয়ে উঠল লেখাপড়া করার অস্ত্র কলমে জায়গা করে নিল পেন ডট পেন খুব সস্তা, সহজলভ্য ব্যবহারের সুবিধার জন্য খুব শীঘ্রই জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিল তবে শৌখিনতা আভিজাত্যে ঝর্ণা কলমের বিকল্প নেই সম্পাদক হর্ষ দত্তের একটি লেখায় পড়েছিলাম বড় বড় সাহিত্যিকদের এক একজনের কাছে ঝর্ণা কলমের গুরুত্ব এক এক রকম কেউ একবার একটি উপন্যাস লিখে সেটি নিজের কাছে রেখে দিতেন, আর ব্যবহার করতেন না কেউ একই কলমে সারা জীবন লিখে যাবার চেষ্টা করতেন উনি লিখেছিলেন – ‘সত্যজিৎ রায় ফাউন্টেন পেন ছাড়া কখনও ডট পেন ব্যবহার করেন নি প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুর বর্ণটি লিখতেন অন্য কালিতে নীল, বেগুনি, সবুজ, খয়েরি প্রত্যেকটি আলাদা এক সময় খুব বড় বড় চুক্তি ব্যাঙ্কের চেক্সই করার জন্য দামী ঝর্ণা কলম ব্যবহার করাটাই প্রচলিত ছিল আজও আভিজাত্যের দিক থেকে এগিয়ে এই কলম ব্যবহার নাই বা করল কেউ


 

মন্তব্যসমূহ