আনন্দ দিতে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত - The enjoyment of watching TV in 80s'

 


কাকিমা, আপনাদের বাড়িতে কাল সন্ধ্যেবেলায় সিনেমা দেখতে আসব। বর্তমান সময়ে যখন নিজের হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্ট ফোনে সবাই সিনেমা, খেলা, টিভি সিরিয়াল দেখছে তখন এই ধরনের অনুরোধের  কথা শুনলে বেশ কানে লাগে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন আমরা সবাই এভাবেই একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সিনেমা, খেলা দেখেছি। আমরা যারা মফস্বল শহরে বড় হয়েছি তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একশ ভাগ সত্যি। আমাদের শহরে সাকুল্যে দুটো সিনেমা হল ছিল। তাতে নতুন সিনেমা আসতে আসতে বছর ঘুরে যেত। আর সিনেমা দেখার দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না। সেই সময় হলে গিয়ে সিনেমা দেখা আমাদের অন্যতম বিনোদন ছিল।                   

           সালটা ১৯৮৩- ৮৪ হবে। সেই সময় কলকাতার পরে আমাদের শহরেও এলো টেলিভিশন।  যদিও তখন খুব কম মানুষের বাড়িতেই টিভি ছিলধীরে ধীরে আমাদের শহরে টিভির সংখ্যা বাড়তে লাগল। আমাদের বাড়িতেও এল টিভি। তখন লম্বাটে চেহাড়ার দুদিকে শাটার দেওয়া বেশ বড় দেখতে টেলিভিশন, সাদাকালো ছবি দেখতে পাওয়া যেত তখন কত রকমের কোম্পানি- টেলেরামা, ওয়েষ্টান, অস্কার, বেলটেক, ওয়েবেল, নেলকো, স্যালোরা, সোনোডাইন, অনিডা ইত্যাদি। যেদিন টিভি বাড়িতে  এল , সেকি উত্তেজনা ! টিভি কোথায় রাখা হবে, কতক্ষন সময় লাগবে, এন্টেনা ছাদে কোথায় লাগানো হবে, বুষ্টার দিতে হবে কিনা, দিতে হলে কটা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন বাড়ির সবার মুখে। অবশেষে সব ঠিকঠাক ব্যবস্থা করে টিভি লাগানো হয়ে গেল। সারারাত টিভি আসার উত্তেজনাতে ঘুম হল না। পরের দিন থেকে সারাদিনে যা যা অনুষ্ঠান দূর্রদর্শনে হয়, তাই বাড়ি শুদ্ধ সবাই দেখছি।  দেখতে দেখতে বেশ মুখস্ত হয়ে গেল কবে বাংলা ছায়াছবির গান হয়, কবে হিন্দীগানের চিত্রাহার, হরেকরকম্বা, দর্শকের দরবারে, কবে স্পাইডারম্যান হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। সেইসময় টিভি নিয়ে দুটো ব্যাপারে বাড়ির বড়দের আপত্তি ছিল। বাড়িতে টিভি থাকলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে এবং চোখ খারাপ হয়ে যাবে। আজকের অনলাইন ক্লাসের যুগে ব্যাপারটা অন্য হয়ে গেল।   

             সেই সময় টিভিতে আমাদের সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল শনিবার সন্ধ্যেতে বাংলা  সিনেমা ও রবিবার হিন্দী সিনেমা। সিনেমা যাই হোক না বাড়িতে বসে দেখতে পাওয়ার মজাই আলাদা। সেই প্রথম বিজ্ঞাপনের বিরতির সাথে পরিচয়।  তখন বিজ্ঞাপন দেখতেই কি ভাল লাগত !  ভাল সিনেমা থাকলে আমাদের ঘর ভরে যেত। আগে থেকেই খাটে, মেঝেতে জায়গা খালি করে রাখতে হত। হৈ হৈ করে চলত গোটা পাড়া মিলে সিনেমা দেখা।  তবে একটা অসুবিধা ছিল দেখতে দেখতে ছবি খারাপ হয়ে যেত। এর কারণ  ছিল  ছাদের অ্যান্টেনা, যেটা বাতাসে দিক পরিবর্তন করলেই ছবি আবছা হয়ে যেত, কোন সময় ছবিই আসত না। তখন আমাদের দুই ভাইয়ের কাজ ছিল ছাদে উঠে এন্টেনা ঠিক করা। ঘোরাতে ঘোরাতে মাঝে মাঝে চিৎকার করতে হত – ছবি দেখা যাচ্ছে কি? উত্তর শুনে আবার সেই অনুযায়ী ডাইনে বা বামে ঘোরানো। বিজ্ঞাপনের বিরতির পাশাপাশি আরো একটা ব্যাপারে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম, সেটা হল অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত মাঝে মাঝেই কানেকশন কেটে যেত, তখন পর্দায় ভেসে উঠত এই ম্যাসেজ। আবার কিছুক্ষন অপেক্ষার পরে ফিরে আসত টিভির অনুষ্ঠান। টিভি তখন কাছে গিয়ে টিভির গায়ে সুইচ ঘুরিয়ে চালাতে হত। এখনকার মত রিমোটের ব্যবহার ছিল না। হাজারটা চ্যানেলও ছিল না, শুধুই দূরদর্শন        

              শুধুমাত্র বড়দের সিনেমা দেখার ভীড় নয়, ছোটরাও ভীড় জমাত বিক্রম বেতাল, স্পাইডারম্যান , হরেকরকম্বা দেখার জন্য।  তবে টেলিভিশনের প্রথম যুগের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল দুই মেগা সিরিয়াল "রামায়ন" ও "মহাভারত"। এত জনপ্রিয় মেগা সিরিয়াল ভারতের টেলিভিশনের ইতিহাসে আসেননি। এর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলকেই টিভির পর্দার সামনে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।  ওই সময়ে এই দুই সিরিয়াল দেখার জন্য আগে থেকেই সবাই নিজের সব কাজ সেরে রাখত। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। বাড়ির বাইরে থাকা  মানুষ যে যেখানে টিভি দেখার সুযোগ পেত , সেখানেই দেখতে শুরু করত এই মেগা সিরিয়াল।  এতটাই মন দিয়ে সবাই দেখত যে এই দুই মেগা সিরিয়াল চলার সময় চারিদিকে শুধুই নিস্তব্ধতা, আবার শেষ হরার পরে ঠিক উল্টো। চারদিক আবার গমগম করত।  সিরিয়াল চলার সময় লোড শেডিং হবার কারণে ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিস ভাঙচুরের ঘটনাও কিছু কিছু ঘটেছে।  

                     এরপরে  আসি খেলার কথায়। আমাদের ছোটবেলা কেটেছে রেডিওতে খেলার ধারাবিবরনী শুনে, তা সে ফুটবলই হোক বা ক্রিকেট।  অজয় বসু, পুষ্পেন সরকারদের চোখ দিয়েই ইডেন উদ্যান, মোহনবাগান ও ইষ্টবেঙ্গল মাঠ চিনেছি। সেটা টিভির পর্দায় দেখার সৌভাগ্য হল ১৯৮৫ সালের পর থেকে। এদিকে বাড়িতেও কিছু বদল হল। আমাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বাবা বাড়িতে নিয়ে এলেন রঙীন টিভি , সাথে বাড়তি পাওনা ইনভার্টার। কারেন্ট চলে গেলেও টিভির অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া যাবে। এরপরে আমরা সাক্ষী থাকলাম ফুটবলের রাজসূয় যজ্ঞ তথা ফুটবল বিশ্বকাপ ১৯৮৬বিশ্বমানের ফুটবল ও বিশ্বের সেরা প্লেয়ারদের সাথে পরিচয় সেই টিভির পর্দাতেই। এর আগে আমাদের বিশ্বমানের খেলা দেখার সৌভাগ্য কোনদিন হয় নি।

                      ধীরে ধীরে আমরা বড় হলাম। টিভিও সাবালক হল। সবার বাড়ির ছাদ থেকে  অ্যান্টেনা ধীরে ধীরে সরে গিয়ে ফাঁকা হয়ে গেল। টিভির বুষ্টার, গেন কন্ট্রোল, স্টেবিলাইজার সব আলমারীর তাকে জায়গা করে নিল। তার জায়গাতে স্থান করে নিল কেবল কানেকশন,  ফল কুড়ি পঁচিশটা চ্যানেলের স্বাদ পাওয়া। দেখতে দেখতে টিভির আকার আয়তনের পরিবর্তন হয়ে গেল। প্রথম যুগের পিকচার টিউবের টিভির আকৃতিটাই এখন আর নেই। উদ্দেশ্য একটাই, ভাল থেকে খুব ভাল ছবি ও পরিস্কার আওয়াজবর্তমানে সেট টপ বক্সের সাথে পাতলা স্ক্রীনের নানান আকারের নানা রকমের টিভি, এল সি ডি, এল ই ডি ইত্যাদিতাতে কয়েকশো চ্যানেল ২৪ ঘণ্টাই বিনোদনের সম্ভার নিয়ে হাজিরঅনেক বাড়িতেই একাধিক টিভি। আটের দশক থেকে আজ অবধি টিভি, চ্যানেল ও তার পরিষেবা উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে, কিন্তু অ্যান্টেনা, পিকচার টিউব টিভি, বুষ্টার বিদায় নেওয়ার সাথে সাথে বিদায় নিয়েছে পাড়ার সবাই মিলে এক জায়গায় বসে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখার নির্মল আনন্দ। যেটা মজবুত করত সম্পর্ককে। জানি না প্রযুক্তির আরো উন্নতি আর কতটা আনন্দ কেড়ে নিয়ে যাবে। সেটা সময়ই একমাত্র বলতে পারবে। আপাতত বলতে পারি – ‘ আনন্দ দিতে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত   

মন্তব্যসমূহ