হারিয়ে যাওয়া পুজোরগান ( SONGS FOR DURGAPUJA ,SHARODIYA )

 

                                   

                         শরতকালের আগমনটা সত্যিই অন্যরকম প্রকৃতি যেন নিজেকে সাজিয়ে জানান দেয়আমি চলে এসেছি বর্ষায় মুখ গম্ভীর করে কালো মেঘে ঢেকে থাকা আকাশ হঠাৎ নীল হয়ে গিয়ে আমাদের মন ভাল করে দেয় আকাশে ভেসে চলা পাতলা সাদা মেঘের নৌকা যেন আগমনীর বার্তা বয়ে বেড়ায় আধুনিকতার মোড়ক সরিয়ে সাদা কাশ ফুলের দোলা আমাদের মনে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে সকাল বেলায় গাছের নীচে পড়ে থাকা শিউলি ফুল ও রাতে জমে থাকা শিশির মনে করিয়ে দেয়মা আসছেন    

 


 

                           আসলে শরতের রূপ প্রথমেই আমাদের আসন্ন দুর্গাপুজোর কথা মনে করিয়ে দেয় তবে প্রকৃতির সাজানো এই রূপের পাশাপাশি শরতকালের আরো কয়েকটা  ঘটনা আমাদের জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে যাদেরকে ছাড়া দুর্গাপুজোর আনন্দের রং আনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। আসলে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে আমাদের যে শারদ উৎসব তা এমনই যে কোনো কিছুর সাথে ‘পুজো’ বা ‘শারদ’ শব্দটি যুক্ত থাকলেই তা আলাদা মাত্রা পায়। যেমন সারা বছর যত ভাল জামাকাপড়ই কেনা হোক না কেন -  পুজোর জামা, পুজোর শাড়ী হলেই তার আনন্দ ও গুরুত্ব বেড়ে যায়।   কাছের মানুষরা যেমন দেখতে চান আমাদের পুজোর কেনাকাটা, তেমনি আমরাও সেগুলি দেখাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি। ঠিক তেমনি পুজোর সাহিত্য ও গান। বছরভর কত শত ম্যাগাজিন , বই প্রকাশিত হলেও বাচ্চা থেকে বড় সকলের নজর থাকে পূজাবার্ষিকীর  দিকে। আসলে পুজোর সময়  শারদ সংখ্যার ম্যাগাজিন হলে তবেই মনটা ভরে পূজাবার্ষিকীর গল্প, উপন্যাস, কবিতা এই সময় আনন্দের জোয়ার এনে দেয় গানের ক্ষেত্রেও একই কথা সারা বছর বহু নতুন নতুন গান আমরা শুনতে পাই কিন্তু পুজোর গানের উন্মাদনা আলাদা সেটার সাথে অন্তরের আনন্দ, ভালবাসা, আবেগ জড়িয়ে থাকে কিন্তু দুঃখের বিষয় পুজোর সাহিত্য আজও কোনো ভাবে বেঁচে থাকলেও পুজোর গানের সেই রমরমা আজ যেন ইতিহাস।  

                                 

                         একটা সময় ছিলো যখন সংগীতপ্রিয় বাঙালীরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতেন পুজোর গানের জন্য। নিজেদের প্রিয় শিল্পীরা কী গান করবেন, কটা গান করবেন, কার গান হিট করবে তা নিয়ে বন্ধুমহলে তর্ক বিতর্কও কিছু কম চলতো না। ১৯১৪ সালে প্রথম পুজোর গান প্রকাশ পেয়েছিলো। সে সময় মাত্র ১৭ টি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিলতখন এক একটা রেকর্ডে দুটি করে গান থাকতো। মোট  ৩৪ টি গান রেকর্ড করা হয়।  এরপর পুজোর গানের জনপ্রিয়তা বাড়তে বাড়তে সত্তরের দশকে তুঙ্গে ওঠে। সেই সময় ‘এইচ এম ভি’ এর তরফ থেকে প্রকাশ করা হতো পুজোর গানের বই ‘শারদ অর্ঘ্য’।  এই বইয়ে থাকতো ‘ এইচ এম ভি’ থেকে রেকর্ড করা সমস্ত শিল্পীদের  গানের কথা, তাদের ছবি, গানগুলির সুরকার ও গীতিকারদের নাম। এক সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো এই বই। হট্‌কেকের মতো বিক্রী হতো বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। এর আগেপূজার ডালিবলেও একটি গানের উপর বই প্রকাশ হতো। 

                                     মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়া কালজয়ী সমস্ত গান এই সময়েই লেখা ও গাওয়া হয়েছিল বলে মনে হয় স্বর্ণযুগের সেইসব শিল্পীদের নাম -  কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর, ঊষা মঙ্গেসকর, রাহুল দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, পিন্টু ভট্টাচার্য, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী -  কাকে ছেড়ে কার কথা বলব এই সমস্ত শিল্পীরাই সেই সময় এইচ এম ভিথেকে রেকর্ড করেছেন শ্রোতারাও   শারদ অর্ঘ্যএর মাধ্যমে  তার সব কিছু তথ্য সংগ্রহ করে নিতেন এভাবে চলতে চলতে শেষবারের মতোশারদ অর্ঘ্যপ্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৪ সালে

 

SHAROOD ARGHYA, DURGA PUJA FESTIVAL SONG
হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া   " শারদ অর্ঘ্য"  এর কয়েকটি পাতা, সাল সম্ভবত ১৯৭৭

 

                                    সেই সময় গান শোনার জন্য রেডিও-ই ছিলো একমাত্র ভরসা আকাশবানীতেঅনুরোধের আসরএ পুজোর কিছুদিন আগে থেকেই পুজোর গানগুলি  শোনানো হতো আমার মনে হয় এমন কোনো সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ছিলেন না যিনিঅনুরোধের আসরশোনার জন্য ব্যাকুল হতেন না এরপর পুজোর সময় একের পরে এক সে এক হিট্পুজোর গান পুজো প্যান্ডেলে বাজতো ও মানুষের মন জয় করে নিতো হলফ্করে বলা যায় এমন কোনো পুজো প্যান্ডেল নেই যেখানে মাইকে শোনা যায় নি - কিশোর কুমারের আমার পূজার ফুল’ ; রাহুল দেবেরফিরে এসো অনুরাধা’ ; আশা ভোষলেরচোখে চোখে কথা বল”,  মান্না দের ‘ সে আমার ছোট বোন’ । আর হৈমন্তী শুক্লা’র ‘ আমার বলার কিছু ছিলো না’ , শ্যামল মিত্রের ‘ কেন তুমি ফিরে এলে’ , সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘ মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’ এর মতো কালজয়ী গান। এমন কি এতকাল পরেও পুজো প্যান্ডেলে শুনতে পাই নির্মলা মিশ্রের ‘ এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’ , আশা ভোঁসলের ‘ কিনে দে রেশমি চুড়ি’ ।

                                        তবে সময়ের সাথে সাথে পুজোর গান হিসাবে আলাদা কোন গান গাওয়ার রেওয়াজ একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। যদিও বা কিছু গান গাওয়া হয় , তবুও সেই অনুভূতি ও আগ্রহ আর শ্রোতাদের মধ্যে নেই। পুজোর সাহিত্য এখনও কোন রকমে টিকে থাকলেও পুজোর গানের সোনালী দিন আর নেই। সময়ের সাথে সাথে যুগ পাল্টেছে, সমাজ জীবন পাল্টেছে, মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে আলাদা করে পুজোর গানের আর কোন আগ্রহ ও মূল্য নেই। তাই আমরা অর্থ্যাৎ সেই যুগের মানুষেরা  শরত এলেই খুঁজে বেড়াই স্বর্ণযুগের পুজোর গানকে। টাইম মেশিনে করে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে সেই সময়ে।




 

মন্তব্যসমূহ